হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে। বাবা রাস্তায় সব্জি বিক্রি করতেন। আক্ষরিক অর্থেই নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া সংসার। মাধ্যমিকের পর আর পড়া হয়নি তাই। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ১৬ বছর বয়সে। বিয়ের পর নিত্যসঙ্গী ছিল স্বামীর মারধর, লাথি, রাতবিরেতে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া। প্রতিবাদ করলে জুটত আরও মার। মাঝেমধ্যেই বন্ধ হয়ে যেত খাওয়াদাওয়া। রোজনামচার সঙ্গী ছিল না খেতে দিয়ে শুকিয়ে মারার হুমকি। কিন্তু সেই সবকিছুই এখন অতীত। টালিগঞ্জের ঘড়িবাড়ি এলাকার বাসিন্দা বিলকিস বিবির লড়াই-এর কাছে হার মেনেছে পরিবার, পাড়া, আত্মীয়স্বজন, সমাজ। গার্হস্থ্য হিংসার কানাগলি পেরিয়ে গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছেন বিলকিস। তিনি এখন পেশাদার ড্রাইভার। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি প্রাণিত করছেন তাঁর মতো অন্য মেয়েদেরও।
আনোয়ার শাহ মোড় সংলগ্ন ঘিঞ্জি গলির ভিতরে একটি ১০ ফুট বাই ১২ ফুট ঘরে দেখা মিলল বিলকিসের। ওইটুকু ঘরেই পরিপাটি সংসার - বিছানা, রান্নার ব্যবস্থা, আলনা। ছোট্ট টেবিলের উপর যত্নে রাখা ড্রাইভিং লাইসেন্স। সদ্য ডিউটি সেরে ফিরেছেন বিলকিস। ক্লান্ত, অথচ আত্মবিশ্বাসে ঝলমল। বিছানা ছাড়া ঘরে অন্য কোনও বসার জায়গা নেই। সেখানে বসেই শুরু হল কথোপকথন।
বিলকিস শুরু করলেন তাঁর ছোটবেলার কথা দিয়ে। "আমার জন্ম গড়িয়ার নতুনহাট এলাকায়। হতদরিদ্র পরিবার। বাবা রাস্তায় বসে তরিতরকারি বিক্রি করতেন। সংসার চালানোই ভার ছিল, পড়াবেন কী করে! মাধ্যমিক পাশ করার পরই আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর কষ্ট তো কমলই না, বরং বাড়ল। স্বামী অন্য এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। আমি সে নিয়ে কথা বললেই শুরু হত প্রবল মারধর। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। বিশ্রাম নিয়ে আবার মারত। মুখ-চোখ ফেটে যেত, রক্ত গড়াত। তাও মারের বিরাম নেই। প্রায়শই মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত। আমি মানতে পারতাম না। লাথি মারতে মারতে বাড়ি থেকে বের করে দিত।"
এমন করেই কয়েক বছর কাটল। বিলকিস এক সন্তানের জন্ম দিলেন। কিন্তু মারধর বন্ধ হল না। বলতে বলতে বিলকিসের গলা ধরে আসে, "বাচ্চার সামনেই আমাকে লাথি মারত। গলা টিপে ধরত। এত অপমান, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমিও চিৎকার করতাম, রুখে দাঁড়াতাম। তখন বলা শুরু হলো আমার নাকি চরিত্র খারাপ। আমি নাকি স্ত্রী হিসাবে খারাপ, মা হিসাবে অযোগ্য।"
মারধর, অপমান, দুর্নাম সহ্য করেও বিলকিস মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন স্বামীর সংসারে। কারণ, আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না তাঁর। বাপের বাড়িতে যাওয়ার প্রশ্নই নেই, দরিদ্র সংসারে আরও একটা পেট বাড়াতে চান নি বিলকিস। আবার একা থাকাও সম্ভব নয়, কারণ কোনও রোজগার নেই। তাঁর কথায়, "মনে হত একটা অন্ধকার গলির ভিতর দিয়ে হাঁটছি যেন। কোথাও যাওয়ার নেই, নিঃশ্বাস নেওয়ার অবকাশটুকুও নেই। পড়াশোনা করি নি, গায়েগতরে খাটা ছাড়া আর কোনও কাজ পারি না। কী হবে আমার? আচমকাই একদিন এক পরিচিতের মাধ্যমে খোঁজ পেলাম একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। তারা নাকি মেয়েদের গাড়ি চালাতে শেখায়। আমার জেদ চেপে গেল। ঠিক করলাম, শিখতেই হবে। গাড়ি চালানোটা কোনওমতে শিখে নিতে পারলেই একটা চাকরি পাব। আর চাকরি মানেই মুক্তি।"
বিলকিস গাড়ি চালানো শিখতে শুরু করলেন। সকালে রান্না, ঘরের কাজ সব সেরে ক্লাসে যেতেন। ফিরে এসে আবার সংসারের যাবতীয় কাজ। কিন্তু বাধা আরও বাড়ল। বিলকিসের কথায়, "স্বামী তো ছিলই, এবার আমার পিছনে পড়ল পাড়ার লোকজন। যুবতী মেয়ে প্রতিদিন কোথায় যায়, কী করে তা নিয়ে শুরু হল অসংখ্য গবেষণা। সে এক দুর্বিষহ সময়। রাস্তায় বেরোলে উড়ে আসছে মন্তব্য, টিটকিরি। বাড়ি ফিরলে জুটছে মার। কিন্তু আমি দাঁত কামড়ে পড়ে ছিলাম। জানতাম, একবার যদি শিখে নিতে পারি, একবার যদি লাইসেন্স পেয়ে যাই, জীবনটাই বদলে যাবে।"
বদলেছে, কিন্তু সময় লেগেছে বেশ খানিকটা। ট্রেনিং শেষের পর পরপর কয়েকটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। চাকরি মেলে নি। কোথাও নেওয়া হয়নি তাঁর লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য, কোথাও আবার নিজের ভুলেই সুযোগ ফস্কেছে। কান্না মেশা হাসি-সহ বিলকিস বলতে থাকেন, "আমার মাথা কাজ করত না। সর্বক্ষণ ভয় করত। মাথায় ঘুরত, বাড়ি গেলেই শুরু হবে মার। লাঠির বাড়ি, লাথি, সব। তাই গুলিয়ে যেত কেমন যেন, পারতাম না।" অবশেষে পারলেন, গত বছরের শেষে চাকরি পেলেন বালিগঞ্জ এলাকায়। সেই শুরু। বিলকিস জানান, তারপর থেকে যতজনের গাড়িই চালিয়েছেন, প্রত্যেকে তাঁকে চোখে হারান।
টালিগঞ্জের ঘুপচি ঘরে বসে বিলকিস বলেন, "প্রথম যেদিন গাড়ি চালিয়ে পাড়ায় এলাম, সবাই চমকে গেল! ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল আমায়। যে লোকগুলো আমায় অপমান করত, বাজে কথা বলত, তাদের চোখের সামনে আমি গাড়িটা পার্ক করলাম, লক করলাম, তারপর বাড়িতে ঢুকলাম। দেখলাম, যে স্বামী আমায় রোজ মারত, সে-ও কেমন যেন অবাক হয়ে গিয়েছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। তারপর থেকে আর কখনও গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, খারাপভাবে কথাও বলে নি। কিন্তু আমার তাতে কিছু যায় আসে না। ও আমার সঙ্গে যা করেছে, আমি কোনওদিন ভুলব না।"
স্বামীর সঙ্গে এত তিক্ত স্মৃতি থাকা সত্ত্বেও কেন আলাদা থাকেন না? বিলকিস বলেন, "কেন আলাদা থাকব? এই বাড়িতে থাকা তো আমার অধিকার! আমি ছেড়ে দেব কেন? যে লোকগুলো আমাকে দিনের পর দিন মেরেছে, অত্যাচার করেছে, অপমান করেছে, তারা এখন আমার সঙ্গে চোখ তুলে কথা বলে না। এখানেই আমার জয়।"
বিলকিস একা জেতেন নি, তাঁর মহল্লার অন্য মেয়েদের কাছে তিনি আইকন। স্থানীয় বাসিন্দা রেজিনা খাতুন বলেন, "এখানকার মেয়েদের অনেক সমস্যা। বিলকিস সেই সব সমস্যার সঙ্গে লড়তে শিখিয়েছে আমাদের।"
আগামী ১ জুন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সম্বর্ধনা দেবে বিলকিসকে। ওই সংস্থার কর্ণধার শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্তের কথায়, "বিলকিস মেয়েদের লড়াই-এর প্রতীক। চরম প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ওর জয় দৃষ্টান্ত তৈরি করুক।" সম্বর্ধনা প্রসঙ্গে বিলকিস অবশ্য লজ্জায় অধোবদন। তাঁর কথায়, "ওঁরা অনেক বড় মানুষ। আমি এর যোগ্য নই। তবুও বলব, খুব ভাল লাগছে। আমি খুশি।"