আয়োজনের কোনও ত্রুটি ছিল না। গত বছর নমঃ নমঃ করেই হয়েছিল পুজো। আশা ছিল, এবার অন্তত জাঁকজমকের কোনও খামতি থাকবে না। প্রস্তুতি ছিল অনেকটাই সেরকম। কিন্তু এবারেও বাদ সাধল করোনাভাইরাস। যার জেরে এবারেও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোতে জারি থাকছে করোনা বিধি, তবে শিথিল করা হয়েছে নাইট কারফিউ। আলোর শহরের তাই আজ মন খারাপ। পুরোদস্তুর উৎসবের মরশুম চলছে। দুর্গাপুজো-কালীপূজোর পর্ব মিটতেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে চন্দননগরের ঐতিহ্যবাহী জগদ্ধাত্রী পুজোর। আর জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই চন্দননগর। আর চন্দননগর মানেই অভিনব আলোকসজ্জা। পুজোর চারটে দিন আলো ঝলমল চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে ভিড় জমান দূর দূরান্ত থেকে কাতারে কাতারে মানুষ। সারারাত ধরেই চলে প্রতিমা দর্শন। এবারের করোনা পরিস্থিতিতে ভিড় নিয়ন্ত্রণে কঠোর প্রশাসন।
কিন্তু দুর্গাপুজো কাটতেই যেভাবে রাজ্যে করোনার সংক্রমণ গতি পেয়েছে, তাতে উদ্বেগ বাড়ছে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্যোক্তাদের। চন্দননগর পুর-প্রশাসন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডকে কনটেনমেন্ট জোনে পরিণত করা হয়েছে। চন্দননগরের সেই সব ওয়ার্ড মিলিয়ে অনেকগুলি জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখানকার পুজো উদ্যোক্তারা চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কী করবেন বুঝে উঠতেই পারছেন না তাঁরা। সামগ্রিকভাবে চন্দননগর ও ভদ্রেশ্বর মিলিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজো হয় ১৭১টি। এর মধ্যে ১২৯টি পুজো চন্দননগরের ১৮টি ঘাটে হয় বিসর্জন। এখন কলকাতায় দুর্গাপুজোর ভিড় এবং তার পরবর্তী করোনা এফেক্ট দেখে, চন্দননগরের পুজো উদ্যোক্তা থেকে পুর-প্রশাসন প্রত্যেকেই চিন্তিত। কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চাইছে না পুলিশ প্রশাসন।
বাড়তে থাকা করোনা গ্রাফের মধ্যে কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনার পরই হুগলি। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এরমধ্যে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভিড় নিয়ন্ত্রণই এখন পুজো উদ্যোক্তা এবং প্রশাসনের প্রথম এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ। চন্দননগরের পুর-প্রশাসক স্বপন কুণ্ডু বলেন, "রাজ্য যা নির্দেশ দিচ্ছে, হাইকোর্ট যা বলছে, তা মেনেই হবে, কনটেনমেন্ট জোনগুলি আছে, তেমনই মাইক্রো কনটেনমেন্ট জোন আছে, পুলিশ এবং পুরসভা নজরদারি চালাচ্ছি, প্রচার করছি। সব দিক মেনেই পুজো হবে। কোথাও কোভিড প্রটোকল না মানা হলে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।" তবে ১২ এবং ১৩ নভেম্বর রাজ্য সরকারের তরফে তুলে নেওয়া হয়েছে নাইট কারফিউ।
বাংলায় এটি জনপ্রিয়ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেছিলেন। প্রায় আড়াইশো বছর আগে, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজো দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। লক্ষ্মীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই পূজার সূচনা। এই পূজা চন্দননগরে আদি পূজা নামে পরিচিত। এবারে ১১ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার সপ্তমী পুজো এবং প্রতিমা নিরঞ্জন ১৪ এবং ১৫ নভেম্বর। আদালতের দেওয়া গাইডলাইন মেনেই এবার ‘মা জগদ্ধাত্রীর’ আরাধনা হবে শহরে। জগদ্ধাত্রী পুজোয় দর্শনার্থীদের মণ্ডপে প্রবেশে থাকছে নিষেধাজ্ঞা। মণ্ডপে প্রবেশাধিকারের ওপরও রয়েছে প্রশাসনের ‘না’। আজই এক নির্দেশিকায় উৎসব আবহে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখার জন্য ১২ এবং ১৩ নভেম্বর তুলে দেওয়া হয়েছে নাইট কারফিউ।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা বিশ্ব-বিখ্যাত। জগদ্ধাত্রী বিসর্জন ও আলোর উৎসব চাক্ষুষ করতে লক্ষাধিক মানুষের ভিড় হয় চন্দননগরে। কিন্তু, এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চন্দননগরের কেন্দ্রীয় পুজো কমিটি কোনও শোভাযাত্রা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শোভাযাত্রা না হওয়ায় মন খারাপ চন্দননগরের। বাগবাজারের বাসিন্দা অনিমিখ সামন্ত জানান, ‘একটা বছর অপেক্ষার পর মা আসেন, চারটে দিন যেমন তেমন, শোভাযাত্রা পুজোর বাড়তি আকর্ষণ। গতবছর করোনা কালে শোভাযাত্রা হয়নি, আশা ছিল এবার হবে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান বাড়তে থাকা করোনা পরিস্থিতি তাতেও বাদ সাধল’। তবে তাঁর গলায় অনেকটাই বিরক্তির সুর। তাঁর কথায়, দুর্গাপুজো আবহে সকল প্রকার নাইট কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছিল রাজ্য সরকারের পক্ষ থেক। শুধু চন্দননগরের রাতের ঠাকুর দর্শনে করোনার প্রকোপ বাড়বে, এমনটার কোনও মানে হয় না’।
এপ্রসঙ্গে চন্দননগর কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটির সাধারণ সম্পাদক শুভজিৎ সাউ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে একান্ত এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ মেনেই সকল পুজো প্যান্ডেল এবং মণ্ডপ সজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভিড় নিয়ন্ত্রণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এবারের শোভাযাত্রা না হওয়ার কারণে আলোকশিল্পীদের উৎসাহিত করতে পথ আলোকসজ্জাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটির তরফে পুরস্কারের আয়োজনও। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রতিটি পুজো-প্যান্ডেলে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। মূলত আলোক শিল্পীদের আরও উৎসাহিত করার লক্ষেই এই আয়োজন করা হয়েছে। চন্দননগরের রাস্তা কার্যত আলোয় মুড়ে ফেলা হবে’।
জগদ্ধাত্রী পুজোর আগে করোনা বিধির কড়াকড়ির ছবি ধরা পড়েছে চন্দননগরের একাধিক জায়গায়। চলছে মাইকিং, মাস্ক পরার ঘোষণা, মাস্ক হীন মানুষজনদের শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চলছে পুলিশের তরফে ধরপাকড়। সব মিলিয়ে এবারের পুজোয় বাড়তি সচেতন পুলিশ প্রশাসন। ইতিমধ্যেই প্রশাসনের তরফে পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রশাসনিক বৈঠকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে, পুজো করতে হলে মানতে হবে সব রকম কোভিড প্রটোকল।
মানুষের ভিড় কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে তা নিয়ে বারবার সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা, এত বারণ সত্ত্বেও দুর্গাপুজোয় আমজনতার বেলাগাম ভিড় বাড়তে থাকা করোনা গ্রাফের অন্যতম কারণ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। সংক্রমণ প্রতিরোধে পুজো উদ্যোক্তা থেকে প্রশাসন - সকলেরই দায়িত্ব আছে। সমান দায়িত্ব পালন করতে হবে সাধারণ মানুষকেও। জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ভিড় নিয়ন্ত্রণে এবারের চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো তাই পুলিশ প্রশাসনের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন