নিজেদেরকে কি নিজেরাই আমরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছি? উৎসব শেষে বাড়তে থাকা করোনা গ্রাফ এ প্রশ্নকেই আরও জোরালো করেছে। কেরলের ওনামের পর একলাফে সংক্রমণ বেড়েছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। ওনাম থেকে শিক্ষা নিয়েও বাঙালি চলতি বছরের উৎসবের দিনগুলিতে করোনাবিধিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে উৎসবের আনন্দের জোয়ারে গা ভাসাল। এত মানুষের জমায়েত কি ভয়াবহ পরিণতির দিকে মানব সভ্যতাকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে তা আমাদের সকলের জানা। তা সত্ত্বেও দুর্গাপূজায় বাঁধভাঙ্গা আনন্দ, আরও একবার মৃত্যুকে বরণ করার সামিল। উৎসব শেষেই লাফিয়ে বেড়েছে করোনা গ্রাফ। শেষ দুদিনে রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৮০০’র গন্ডি পেরিয়েছে।
কেন এই বেপরোয়া মনোভাব? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে দেশের চিকিৎসকরা বারবার সজাগ করলেও তাঁদের সাবধানবাণীকে উপেক্ষা করে আমরা মেতেছি উৎসবের আলো আধারির খেলায়। সাবধানবানী তো ছিলই। তাহলে? সকলে ভেবেছিল টিকার একটা ডোজ তো হয়ে গেছে, কারও বা দুটো। আর কতদিন এভাবে ঘরবন্দী থাকা যায়! বারন সত্বেও হাফিয়ে ওঠা ঘরবন্দী মানুষের উৎসবের আনন্দের জোয়ারে গা ভাসানোর পরিনতি ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন তাবড় চিকিৎসকরা।
করোনা দৈনিক সংক্রমণ রাজ্যে ফের ৮০০’র গন্ডি ছাড়িয়েছে পরপর দু’দিনই। তবে কী আশঙ্কা সত্যি করে তৃতীয় ঢেউ আসতে শুরু করেছে? গড়ে এরাজ্যে করোনা টেস্টের সংখ্যা অনেকটাই কম হয়, তা এর আগেও চিকিৎসকদের একাংশ অভিযোগ করেছিলেন। যা উৎসবরে মরসুমে আরও কমে গিয়েছিল, এমনটা তাঁরা মনে করছেন।
বিশিষ্ট চিকিৎসক মানস গুমটা বলেন, ‘আমাদের রাজ্যে দৈনিক টেস্টের সংখ্যা কম। উৎসব আবহে সেই টেস্টের সংখ্যা একলাফে অনেকটাই কমে গিয়েছিল। দ্রুততার সঙ্গে এই টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আক্রান্তদের দ্রুত আইসোলেট করতে হবে। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করতে হবে। করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন তাঁদের কোয়ারান্টিনে পাঠাতে হবে।’ উৎসবের মরসুমে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধিকে ম্যান মেড বলেও কটাক্ষ করেন তিনি। ডা. মানস গুমটা বলেন, ‘এছাড়া হাসপাতালগুলিতে করোনা রোগীদের জন্য ক্রিটিক্যাল কেয়ারের পরিষেবাকে প্রস্তুত রাখতে হবে। জনস্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
আরও পড়ুন- ডবল ডোজের আত্মবিশ্বাসে ঊর্ধ্বমুখী করোনা গ্রাফ! মাস্কহীন উল্লাসে সংক্রমণের হাইজাম্প
পুজোর সময় করোনাবিধিকে শিথিল করার কড়া সমালোচনা করেছেন ডা. মানস গুমটা। তিনি বলেন, 'আমাদের তরফ থেকে বারবার সতর্ক করা করা হয়েছিল রাজ্য সরকারকে, তা সত্বেও পুজোর সময় রাতের করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছিল রাজ্য সরকারের তরফে, যার ফলে আরও বেশি জমায়েত হয়েছে।’ তাঁর মতে, ‘প্রায় ১৮ মাস ধরে একটানা পরিষেবা দিতে দিতে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা আজ বড়ই ক্লান্ত। ইতিমধ্যেই প্রায় ১৪০০ জন চিকিৎসক করোনাতে প্রান হারিয়েছেন, রাজ্যের ক্ষেত্রেও সেই সংখ্যা নেহাতই কম নয় প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন। তাঁরা তাদের প্রাণের বিনিময়ে করোনা চিকিৎসা করে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। এবারে যদি সত্যি আশঙ্কা সত্যি করে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসে তা সামাল দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য।’
অন্যদিকে বিশিষ্ট চিকিৎসক সুমন পোদ্দারের গলায় আতঙ্কের সুর। তাঁর কথায়, ‘টিকা এবং মানুষের বেপরোয়া মনোভাবের মাঝে যে কোনও সময়েই উঁকি দিতে পারে বিপদ।’ তিনি মানুষের এহেন বেপরোয়া এবং লাগামছাড়া মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সুমন পোদ্দার বলেন, ‘বারবার সাধারণ মানুষকে সাবধান করা সত্বেও সেকথা তাঁরা কানে নেননি, তাই আজ আবার করোনা গ্রাফ উর্দ্ধমুখী।’ করোনার তৃতীয় ঢেউ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘মানুষ যদি নিজে থেকে যেচে এই রোগকে ডেকে নিয়ে আসেন তাহলে তৃতীয় কেন আরও বেশ কতগুলো ঢেউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে তার ঠিক নেই।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৌমেন দাসের কথাতেও উঠে এসেছে একই সুর। তিনি বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি মানব শরীরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠলেও কো-মর্বিডিটি আছে এমন মানুষের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস যে কোনও সময়েই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। বয়স অল্প হওয়ার কারণে অনেকেই রোগটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না এমন প্রবনতা যথেষ্টে ঝুঁকিপূর্ণ।’ তবে উৎসবের ভিড়ে মানুষের বেপরোয়া মনোভাবকে কোনও ভাবেই মানতে পারছেন না তিনি। তাঁর কথায়, ‘দ্বিতীয় ঢেউয়ে এত মানুষের মৃত্যু যদি সাধারণ জনগনকে সচেতন করতে না পারে তাহলে মানুষ কীভাবে সচেতন হবেন?’ প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজোয় লাগামছাড়া আনন্দ। সাজগোজ-হুল্লোড়ের মধ্যে ভাঁটা পড়েছিল করোনা সচেতনতায়। প্যান্ডেল হপিং-এ উধাও হয়েছিল সোশাল ডিসট্যান্সিং। পুজোর দিনগুলিতে কোভিডবিধি উপেক্ষার ফলই কি হাতেনাতে মিলছে? গত কয়েকদিন কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যের ঊর্ধ্বমুখী করোনা গ্রাফ দেখে বড় হয়ে উঠেছে এই প্রশ্ন। রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, দশমীর পর থেকে লাগাতার বেড়েছে সংক্রমণ। কার্যত বিদ্যুৎ গতিতে সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যুহার খুবই কম। আর সেটাই কিছুটা হলেও অন্ধকারে একচিলতে আশার আলো।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন