হাইকোর্টের মুখোমুখি দাঁড়ালে পাশের ডান দিক হয়ে যে রাস্তা সোজা চলে যাচ্ছে। রাস্তার উলটো ফুটে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে ছাপোষা এক বাড়ি। তার নিচে এক চিলতে দোকান। দোকানের পাশে চুন খসা দেওয়াল। মাথার উপর লাল হলুদ বোর্ডে লেখা উকিল বাবুর হোটেল। সম্ভবত কলকাতা হাইকোর্ট চত্বরের প্রথম ভাতের হোটেল। ১৪০ বছরের পুরনো। কলকাতা শহরে খাবার হোটেলের অভাব নেই। ফাস্ট ফুড লাইফে এদের মতন পুরনোরাই আজও গর্বের সহিত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। এমনটা ঘটেছে উকিল বাবুর হোটেলের ক্ষেত্রেও। হাইকোর্ট চত্বরে সকলের মুখে মুখে উকিল বাবুর হোটেল নামে পরিচিতি পেলেও আসল নাম হেস্টিংস রেস্টুরেন্ট এন্ড ইটিং হাউস।
কলকাতায় পাইস হোটেলের গল্পটা শুরু আজ থেকে দেড়শ-দুশো বছর আগে। ইংরেজরা তখন পুরো দমে শাসন চালাচ্ছে ভারতবর্ষে, আর কলকাতা যেন তাদের নয়নের মণি। রোজ রোজ গড়ে উঠছে ছোটোখাটো কারখানা, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ব্রিজ,অট্টালিকা। কলকাতা শহর ভালো কাজ পাওয়ার জন্যে আদর্শ। এই ভেবে সেই সময় গ্রামগঞ্জের ছেলে ছোকরারা শহরে কাজের খোঁজে আসতে শুরু করে। কিন্তু কাজ করলেই তো হল না। থাকার জন্যে ছাদ চাই, খাবার চাই। শুরু হয় মেসবাড়ি কালচার। আপিসের অনিলবাবু থেকে কলেজের ছাত্র অপূর্ব থাকতে শুরু করে একই ছাদের নীচে একই ঘরে। প্রথমদিকে যা শোনা যায়, এই মেসবাড়ি গুলিতে রান্না নিজেরাই করা হতো। আর মেনুতে ডাল-আলু সেদ্ধ ব্যতিত আর কিছু সেইভাবে থাকতো না। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে ডালে-চালে ফুটিয়ে হতো খিচুড়ি, আর সে যেন মহাভোজ। কিন্ত ক্রমশ এই একই খাবার গলাধঃকরণ করতে করতে ডাল ভাতের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতে শুরু করে প্রায় সকলের। কিন্তু কিইবা করা যায়? সাহেব-দের মত বড় বড় হোটেলে খাওয়ার সামর্থ্য তো এই চাকুরীজীবী ও কলেজ পড়ুয়াদের ছিলনা! কাজেই বিকল্প পথ খোঁজার সময় এসে গিয়েছিল। জন্ম হল 'পাইস হোটেলের'।
মা-ঠাকুমার হাতের খাবারের স্বাদের থেকে বঞ্চিত বাঙালি, ফিরে পেল সেই স্বাদ কিন্তু এক অন্যরূপে। এই পাইস হোটেলগুলিতে পাওয়া যেত, ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ, মাংস, ডিম প্রায় সব কিছুই, তাও সুলভ মূল্যে। তো এই সমস্ত মেসবাড়ির ছেলেপুলেদের খাওয়া-দাওয়ার সমস্যার অবসান হল পাইস হোটেলের হাত ধরে। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হতে থাকল ঘরোয়া রান্নার এসব হোটেল। দামে কম মানে ভালো। এরকম সময়ে কলকাতা আদালত চত্বরে তৈরি হল উকিল বাবুর হোটেল। যদিও তখন নাম এর অন্য নাম ছিল। আরও ১৫ টা হোটেল ছিল এই চত্বরে। যদিও সময়ের সঙ্গে সেসবের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সালটা ১৮৮৫। তখন কলকাতা হাইকোর্টের এই রাস্তাটার নাম ছিল হেস্টিংস রোড (বর্তমান নাম কিরণ শঙ্কর রায় রোড নামে পরিচিত)। তখন জনৈক ব্যক্তি হেস্টিংস নাম দিয়ে এক ফালি একটি দোকান খোলেন, বাঙালিরা যাতে রাস্তায় বেরিয়ে ঘরের মতো অল্প তেলমশলার খাবার খেতে পারে সেই উদ্দেশ্যে। বর্তমানে দোকানের মালিক শৈলেন্দ্রুকুমার রক্ষিত। ক্যাশ বাক্সের সামনে সস্ত্রীক বসে, খদ্দের সামলে বলছিলেন, "উকিলবাবুরাই নতুন কাউকে খাওয়ার জন্য উকিলবাবুর হোটেলে যাওয়ার সুপারিশ করেন। ওখানে গেলেই ভালো খাবার পাওয়া যায়। অনেক দূর থেকে মানুষ আসে তাঁদেরই মুখে মুখে হেস্টিংস নাম বদলে হয়ে গেল, 'উকিলবাবুর হোটেল'। আদালত চত্বরে এটি এখন সবার কাছে একটা পরিচিত জায়গা।"
শৈলেন্দ্রুবাবুই বলছিলেন পুরনো সব ইতিহাস, "হোটেলের মালিকানা বেশ কয়েকবার বদল হয়েছে। ১৯৪২ সালে মালিকানা আসে আমার বাবার কাছে। তার আগে দোকান কার ছিল তা বলা সম্ভব নয়।" শৈলেন্দ্রুবাবু নিজেও ওকালতি করেন। বললেন, 'বাবা ১৯৭২ সালে আমার হাতে দায়িত্ব তুলে দেন। তারপর কাজ করতে করতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়েছি। বাবা সুকুমার রক্ষিত ছিলেন মুহুরি। একটা সময় হোটেলের পূর্বতন মালিক আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন। বাবা তাঁকে তখন সাহায্য করেন। তবে টাকা শোধ না করে হোটেলের মালিকানা বাবাকে দিয়ে দেন তিনি।" এই দোকানের সিগনেচার ডিস কবিরাজি ঝোল। চলতি কথায় তার নাম 'লাইট ঝোল'। উকিলবাবুর হোটেলের দেওয়ালে আজও যেন অতীতের ছোঁয়া। বছর দু'য়েক হল নতুন বোর্ড লেগেছে। দোকানের ভিতরে তিনটি মাত্র কাঠের বেঞ্চ-টেবিল। ঘরোয়া রান্না এখানকার ইউএসপি।
কাঁচকলা-পেঁপে-জিরে-মরিচ দিয়ে বানানো পাতলা ঝোল, রোগীর পথ্যির সামিল। ফ্যাকাসে রং, তার মধ্যে আবার মাছ আর অন্যান্য সবজি ভাসে। এ ঝোল নাকি পেট ঠাণ্ডা রাখে। এই গরমে উকিল বাবুদের প্রথম পছন্দের জায়গা। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় রান্নার তোরজোড়। বেলা বাড়ার সঙ্গে ভিড় করতে থাকে খদ্দের। এক চিলতে দোকানের সামনে উকিল থেকে মক্কেল সকলের লাইন লেগে যায়। এখানে শুধুমাত্র পাওয়া যায় কবিরাজি ঝোল। যা এই গরমে পেটের রোগে কাজ দেয়। অতি সাধারণ জিনিসকে সঙ্গে নিয়েই দেড়শো বছরে দিকে এগিয়ে চলছে কলকাতা হাইকোর্টের উকিল বাবুর হোটেল।