Advertisment

বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট যেন অষ্টমীর কলকাতা! বিপর্যয়ের আশঙ্কায় বিশেষজ্ঞরা

পার্ক স্ট্রিটের ভিড় সামাল দিতে নাজেহাল অবস্থা পুলিশ প্রশাসনের। আর এই ভিড় দেখেই শঙ্কিত চিকিৎসকমহল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
দুয়ারে ওমিক্রন, বর্ষবরণের ভিড় নিয়ন্ত্রণই এখন প্রশাসনের বড় চ্যালেঞ্জ!

বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট যেন অষ্টমীর কলকাতা! বিপর্যয়ের আশঙ্কায় বিশেষজ্ঞরা

ওমিক্রন আতঙ্কে নাজেহাল বিশ্ব। করোনার নয়া এই প্রজাতির হাত ধরেই তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে চলেছে এমনই সতর্কবাণী শুনিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভারতে ইতিমধ্যেই ১৭টি রাজ্যে হানা দিয়েছে ওমিক্রন। বাদ যায়নি বাংলাও। তবে বড়দিনের শহরের যে ছবি ঘোরাফেরা করেছে একাধিক সংবাদ মাধ্যম-সহ সোশ্যাল মিডিয়ায়, তা নিয়ে রীতিমতো আশঙ্কার কালো মেঘ দানা বেঁধেছে।

Advertisment

করোনার চোখ রাঙানি উড়িয়ে বড়দিনের রাতে মানুষের ঢল নামল কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে। সকাল থেকেই সেখানে জনসমাগম ছিল চোখে পড়ার মত। রাত গড়াতেই বাড়তে থাকে ভিড়। শিকেয় উঠেছে করোনাবিধি। সামাজিক দূরত্ব তো দূরের কথা, অনেকের মুখে দেখা মেলেনি মাস্কেরও। মাইকিং করে ভিড় নিয়ন্ত্রণে নামে পুলিশ। তাতে কর্ণপাত না করেই ভিড়ে গা ভাসায় উৎসাহী জনগণ। ভিড় সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে পুলিশকে।

মানুষের এমন বেপরোয়া আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ক্রিস্টমাস ডে পালন করতে রাস্তায় নেমে কাতারে কাতারে মানুষ। গত কয়েকদিন ধরেই মানুষের ঢল মধ্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে। তবে বড়দিনের ভিড় সব রেকর্ড মুছে ফেলেছে। বুধবার থেকেই সেজে উঠেছিল গোটা এলাকা। আলোর রোশনাই থেকে বাহারি গেট দেখতে অভ্যস্ত বাংলার মানুষ। গোটা রাস্তা ধরেই আলো দিয়ে সেজে উঠেছে পার্ক স্ট্রিট। আর বড়দিনে কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়েছে দক্ষিণ কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে। অধিকাংশের মুখে নেই মাস্ক। কারুর বা মাস্ক ঝুলছে থুতনিতে। আর তা দেখেই শঙ্কিত চিকিৎসকমহল। পার্ক স্ট্রিটের ভিড় সামাল দিতে নাজেহাল অবস্থা পুলিশ প্রশাসনের। বিকেল হতেই জমজমাট গোটা এলাকা। রঙ বাহারি পোশাকে সেজে সেলফি তোলার হিড়িক।

publive-image
বড়দিনে শহরের দুই জায়গার ভিড়ের চিত্র, ছবি- শশী ঘোষ

কালো মাথার ভিড়ে করোনা আতঙ্ক কোথাও যেন চাপা পড়ে গিয়েছে। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। বড়দিন উপলক্ষে যে চিত্র ধরা পড়েছে তাতে কোথাও ছিল না সামাজিক দুরত্ববিধি। রাস্তার ধারে থাকা স্টলগুলো থেকে গায়ে গা লাগিয়ে অবাধেই চলল দেদার খানাপিনা। অনেকেই অবশ্য এই বেলাগাম ভিড় নিয়ে রাজ্য সরকারকে একহাত নিয়েছেন। তবে করোনাকালে বিশেষত ওমিক্রন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের এমন বেপরোয়া মনোভাব বিপদ বাড়াচ্ছে মত বিশেষজ্ঞদের।

Centre to send teams to 10 states with high Omicron cases
সংক্রমণ বাড়লেও উধাও দূরত্ববিধি।

বড়দিনের পর বর্ষবরণ উৎসব নিয়ে মাতবে জনগণ। সপ্তাহভর চলবে আগামী বছরকে সাদরে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি। তবে উৎসবের দিনগুলিতে মানুষের ভিড়ের সঙ্গে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ। তার ওপর রয়েছে ওমিক্রন সংক্রমণ। সব মিলিয়ে সংক্রামিতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞ মহল। এদিকে ওমিক্রন পরিসংখ্যান হু হু করে রাজ্যে বাড়ছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। ওমিক্রন গ্রাফের বাড়বাড়ন্ত রীতিমতো চিন্তায় রাখছে প্রশাসন থেকে রাজ্যবাসীকে। ইতিমধ্যেই মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে হুহু করে বেড়েছে ওমিক্রন আক্রান্তের সংখ্যা। ২০০ থেকে এক লাফে সংখ্যাটা ৪২২-এ পৌঁছেছে।

ওমিক্রন মোকাবিলায় দেশজুড়ে চূড়ান্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বড়দিনের দিন শহরের এমন যে তৃতীয় ঢেউকে ডেকে নিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। কেন এই বেপরোয়া মনোভাব? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে দেশের চিকিৎসকরা বারবার সজাগ করলেও তাঁদের সাবধানবাণীকে উপেক্ষা করে আমরা মেতেছি উৎসবের আলো আধারির খেলায়। ওমিক্রন ত্রাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বড়দিনের আনন্দের জোয়ারে গা ভাসালেন লাখ মানুষ। কী পরিণতি অপেক্ষা করে আছে কী বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বিশিষ্ট চিকিৎসক মানস গুমটা বলেন, “আমরা নিজেরাই যেন নিজেদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বজুড়ে দাপট দেখাতে শুরু করেছে করোনার নয়া প্রজাতি ওমিক্রন। ডেল্টা ভাইরাসের থেকেও কয়েকগুণ সংক্রামক ওমিক্রন তা জানা সত্ত্বেও বড়দিনের দিন যে ছবি ধরা পড়েছে তা মোটেও কাম্য নয়”।

Corona Bengal, Christmas Celebration, Kolkata
শহরের রাজপথে মায়ের কোলে শিশু। মুখে নেই মাস্ক। এই আচরণ ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। ছবি: শশী ঘোষ

তিনি বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে টিকার দুটি ডোজ নেওয়া হলেও অনেকে মানুষ এই নয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাদের তৃতীয় ঢেউ রুখতে এগিয়ে আসতে হবে।" বড়দিন উপলক্ষে করোনাবিধিকে শিথিল করার কড়া সমালোচনা করেছেন ডা. মানস গুমটা। তাঁর কথায়, “আমাদের তরফ থেকে বারবার সতর্ক করা করা হয়েছিল রাজ্য সরকারকে, তা সত্ত্বেও উৎসব আবহে রাতের করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছিল রাজ্য সরকারের তরফে, যার ফলে আরও বেশি জমায়েত হয়েছে”। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৮ মাস ধরে একটানা পরিষেবা দিতে দিতে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা আজ বড়ই ক্লান্ত। ইতিমধ্যেই প্রায় ১৪০০ জন চিকিৎসক করোনাতে প্রাণ হারিয়েছেন, রাজ্যের ক্ষেত্রেও সেই সংখ্যা নেহাতই কম নয় প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন। তাঁরা তাদের প্রাণের বিনিময়ে করোনা চিকিৎসা করে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। এবারে যদি সত্যি আশঙ্কা সত্যি করে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসে তা সামাল দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য।’

অন্যদিকে ওমিক্রন থেকে রেহাই মেলেনি শিশুদেরও। এর মধ্যেও বড়দিনের রাত্রে শহরের বুকে যে চিত্র ধরা পড়েছে তা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ইন্দ্রনীল চৌধুরী। তাঁর কথায়, শিশুদের টিকা দানে কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি। তার মাঝেই ওমিক্রন নিয়ে সতর্কবাণী মিলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে। আমরা দেখেছি, ওমিক্রন শিশুদেরও রেহাই দিচ্ছে না। এক্ষেত্রে বাবা মাকে অনেক বেশি সাবধানতা মেনে চলতে হবে। এত ভিড় যে শিশুদের জন্য অনেক বেশি বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে,  মাস্কহীন শিশুদের সংখ্যা নিয়ে তিনি বাবা মায়ের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁর কথায়, "শিশুদের প্রথম বন্ধু তাদের বাবা মা। এক্ষেত্রে বাবা মা যদি সঠিক ভাবে শিশুদের গাইড না করেন তবে বিপদ সামনেই”।

publive-image
বড়দিনে মানুষের ঢল কলকাতায়, ছবি - শশী ঘোষ

বিশিষ্ট চিকিৎসক সুমন পোদ্দারের গলায় আতঙ্কের সুর। তাঁর কথায়, ‘টিকা এবং মানুষের বেপরোয়া মনোভাবের মাঝে যে কোনও সময়েই উঁকি দিতে পারে বিপদ।’ তিনি মানুষের এহেন বেপরোয়া এবং লাগামছাড়া মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সুমন পোদ্দার বলেন, ‘বারবার সাধারণ মানুষকে সাবধান করা সত্বেও সেকথা তাঁরা কানে নেননি, ওমিক্রন এবং করোনার তৃতীয় ঢেউ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘মানুষ যদি নিজে থেকে যেচে এই রোগকে ডেকে নিয়ে আসেন তাহলে তৃতীয় কেন আরও বেশ কতগুলো ঢেউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে তার ঠিক নেই।’

publive-image
শভিড়ে গা ভাসিয়ে উৎসাহী জনগণ, ছবি- শশী ঘোষ

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৌম্যজিত গুহ’র কথাতেও উঠে এসেছে একই সুর। তাঁর কথায় বয়স অল্প হওয়ার কারণে অনেকেই রোগটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না এমন প্রবণতা যথেষ্টে ঝুঁকিপূর্ণ।’ তবে বড়দিনের উৎসবের ভিড়ে মানুষের বেপরোয়া মনোভাবকে কোনও ভাবেই মানতে পারছেন না তিনি। তাঁর কথায়, ‘দ্বিতীয় ঢেউয়ে এত মানুষের মৃত্যু যদি সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে না পারে তাহলে মানুষ কীভাবে সচেতন হবেন?’ প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

তিনি আরও বলেছেন, বড়দিন সহ উৎসবের এই বিশেষ দিনগুলি শুধু সাধারণ মানুষ নয় প্রশাসনের কাছেও বড় চ্যালেঞ্জ। বড়দিনের রাতের যে ছবি আমাদের সামনে উঠে এসেছে তা নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনে যাতে ধরা না পড়ে তার জন্য তিনি সাধারণ মানুষকে অনুরোধ জানিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি  উৎসবের মরশুমে রাজ্য সরকারকেও লাগাম ছাড়া ভিড় নিয়ন্ত্রণে কিছুটা কঠোর হওয়ারও আবেদন জানিয়েছেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

COVID-19 Omicron Festive Gatherings
Advertisment