কলকাতা পুলিশ। নামটা শুনলেই একসময় অনেক অপরাধীর হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে যেত। বিশ্বে অপরাধ দমনে যারা অন্যতম সেরা বাহিনী, সেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে একসময় কলকাতা পুলিশের তুলনা চলত। কিন্তু, এটুকুই কি শেষ? ইতিহাস কিন্তু, অন্য কথা বলে। যা দাবি করে, বিশ্বের অপরাধ বিজ্ঞানকে পথ দেখিয়েছে কলকাতার অন্যতম গর্ব কলকাতা পুলিশই।
শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর অন্যতম উজ্জ্বল আর মর্মভেদী দুটি চোখ। যার মধ্যে চৌম্বকীয় আকর্ষণ। চোখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। পাশে তাঁর সহকর্মীকে দেখলে মনে হবে, অপেক্ষাকৃত সাধারণ। তবে ওই যে ইংরেজিতে বলে, ‘appearances can be deceptive’, অর্থাৎ চেহারা দিয়ে বিচার না-করাই ভালো। কাদের কথা বলা হচ্ছে এখানে? আর কয়েক মিনিটেই উত্তর পাবেন।
তার আগে একটা খুনের ব্যাপারে কথা সেরে ফেলা দরকার। বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলার কাঠালগুড়ি চা বাগান, ১৮৯৭ সালের ১৬ আগস্টের সকাল। বাগানের ম্যানেজার হৃদয়নাথ ঘোষকে পাওয়া গেল তাঁর বাংলোর মেঝেতে, পড়ে আছেন গলার নলিকাটা অবস্থায়। সন্দেহের তালিকায় একেবারে প্রথমেই উঠে এল তাঁর গৃহভৃত্য রঞ্জন সিং ওরফে ‘কাঙালি’-র নাম। ঘোষবাবুর বাড়িতে চুরির অপরাধে ছ’মাস জেল খাটার পর যে সদ্য ছাড়া পেয়েছে।
ঘটনাস্থলে রক্তাক্ত আঙুলের ছাপের কল্যাণে কাঙালিকে খুনি সাব্যস্ত করল পুলিশ। পৃথিবীতে সেই প্রথমবার কোনও অপরাধের সমাধানে ব্যবহৃত হল আঙুলের ছাপ, অন্তত সরকারিভাবে। ভাবতে অবাক লাগছে? আরও অবাক করা কথা শুনবেন? এই সমাধান সম্ভব হয় একটি মাত্র কারণে – সে বছরেরই মার্চ মাসে কলকাতায় স্থাপিত হয়েছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম ‘ফিঙ্গারপ্রিন্টস ব্যুরো’। এর পিছনে প্রধান ভূমিকা ছিল তিন পুলিশকর্মীর– সেই উজ্জ্বল চোখের অধিকারী সাব-ইনস্পেক্টর আজিজুল হক, তাঁর শান্তশিষ্ট সহকর্মী সাব-ইনস্পেক্টর হেমচন্দ্র বসু, এবং তাঁদের তত্ত্বাবধায়ক স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি। যিনি ছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল পুলিশের আইজি, পরবর্তীকালে হয়েছিলেন লন্ডন পুলিশের কমিশনার।
এখানে মনে রাখা দরকার, নামীদামি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে পর্যন্ত ১৯০১ অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল নিজস্ব ফিঙ্গারপ্রিন্টস বিভাগ খোলার জন্য। তবে আসল কথাটা হল, ‘Henry Classification System of Fingerprints’ নিয়ে প্রচুর লেখালিখি, আলোচনা হয়েছে। অপরাধের সমাধানে আঙুলের ছাপ ব্যবহার করা যে বিজ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে, তার ‘পথিকৃৎ’ হিসেবে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন হেনরি সাহেব অর্থাৎ স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি।
অথচ আজ পর্যন্ত কোনও আলোচনা হয়নি ‘Bose-Haque-Henry system of classification’ নিয়ে। যা হওয়া উচিত ছিল। কেন? কারণ ১৮৯১ সালে যখন বিভিন্ন আঙুলের ছাপ ও তাদের শ্রেণিবিভাগ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন, তখন হেমচন্দ্র এবং আজিজুলই কিন্তু সেই গবেষণার শিরদাঁড়া গঠন করেন নিজেদের অঙ্ক ও নৃতত্ত্ব শিক্ষা দিয়ে। ১৮৯৭ সালের মার্চ মাসে সরকারি কমিটির অনুমোদন মেলে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে আঙুলের ছাপ ব্যবহারের। যার ফলে চালু হয়ে যায় ব্যুরো।
মাসকয়েক পরে কাঠালগুড়িতে হাতেনাতে এই পদ্ধতি পরীক্ষার সুযোগও এসে যায়। তবে ১৮৯৮ সালের ২৫ মে আদালতে বেকসুর খালাস হয়ে যায় রঞ্জন সিং ওরফে কাঙালি। কারণ? ভারতীয় আইনের চোখে তখনও আদালতে অপরাধের প্রমাণ হিসেবে মান্যতা লাভ করেনি আঙুলের ছাপ। স্পষ্ট হয়ে গেল, আইনে বদল প্রয়োজন। সুতরাং ১৮৯৯ সালে আইনসভায় গৃহীত হল সংশোধনী আইন, যার ফলে দেশের আইন ব্যবস্থায় পাকাপাকি স্থান পেল ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট এভিডেনস’।
এর ঠিক ১০ বছর আগে, ১৮৮৯ সালে ‘বেঙ্গল পুলিশ সার্ভিস’-এ যোগ দেন হেমচন্দ্র বোস, সাব-ইনস্পেক্টর হিসাবে। গাণিতিক মেধায় বিস্ময়বালক আজিজুলকেও ওই সাব-ইনস্পেকটর পদেই প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র থাকাকালীন তুলে আনেন স্যার এডওয়ার্ড। হেমচন্দ্র এবং আজিজুল, দু'জনেরই কাজের তত্ত্বাবধান করতেন তিনি নিজে।
তবে হেনরির গবেষণায় সাহায্য করার সময় দুই সদ্যযুবা বঙ্গসন্তান জানতেন না, তাঁরা পৃথিবীর ইতিহাসের শরিক হতে চলেছেন।একাধিক ইতিহাসবিদের ধারণা, আঙুলের ছাপ সংক্রান্ত গবেষণায় তুঙ্গস্পর্শী সাফল্য সত্ত্বেও প্রত্যাশিত স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিতই থেকেছেন হেমচন্দ্র-আজিজুল। অবসর পরবর্তী জীবনে স্রেফ ‘রায়বাহাদুর’ আর ‘খানবাহাদুর’ অভিধায় তাঁদের অবদানের সবটুকু মাপা যায় না।
হেনরি নিজেই উদাসীন থেকেছেন দুই ভারতীয়কে যথোচিত সম্মানদানে। গবেষণা-সহায়ক হিসেবে আজিজুলের নাম উল্লেখ করেছেন ১৯২৬ সালে। হেমচন্দ্রকে মনে পড়েছিল আরও চার বছর পর। ১৯৩০ সালে লিখেছিলেন, 'আঙুলের ছাপের সার্চ কীভাবে করা যায়, কত নিখুঁতভাবে করা যায়, সে বিষয়ে হেমচন্দ্র ছিলেন নিরলস, একনিষ্ঠ। সেই নিষ্ঠার ফলশ্রুতিতে যে সাফল্য এসেছে, তার অনেকটাই কৃতিত্ব হেমচন্দ্রের প্রাপ্য।' তাঁর কথা থেকে মনে হতে পারে, আজিজুলের চেয়ে এব্যাপারে হেমচন্দ্রের কৃতিত্ব বেশি। তবে বর্তমানে অবলুপ্ত ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকায় জনৈক এস. হেইলক লিখেছেন, 'It seems that Haque devised the basis of the classification system we now know, and took it to his boss, Edward Henry.'
১৯২৫ সালের জুন মাসে উড়িষ্যা ও বিহারের চিফ সেক্রেটারি আজিজুলের নামে একটি সাম্মানিকের সুপারিশ করে লেখেন আঙুলের ছাপের শ্রেণিবিভাগ সংক্রান্ত গবেষণায় আজিজুলের প্রাথমিক কাজের ভিত্তিতেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন হেনরি। সুতরাং হেমচন্দ্র-আজিজুল জুটির গুরুত্ব ওভাবে ভাগ না-করাই উচিত।
এছাড়াও হেনরির ওপর সমস্ত নজর গিয়ে পড়ার ফলে কিছুটা বঞ্চিত হয়েছেন আরও একজন। তিনি স্যার উইলিয়াম জেমস হার্শেল, একদা হুগলির জেলাশাসক, যিনি ১৮৫৮ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি কাজে ব্যবহার করেছিলেন আঙুলের ছাপ। যদিও তাঁর এই প্রয়াস সরকারি স্বীকৃতি লাভ করেনি। অনেকেরই মনে থাকতে পারে, হার্শেল-এর নাম আগেও শুনেছি। মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে ফেলুদাকে সিধুজ্যাঠার প্রশ্ন, 'Who was William James Herschel?'
ওদিকে ইংল্যান্ডে বসে ১৮৯০ সালে এই একই বিষয়ে গবেষণা করছিলেন স্যার ফ্রান্সিস গলটন। প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, পৃথিবীতে কোনও দুই ব্যক্তির আঙুলের ছাপ এক নয়, এমনকি হুবহু যমজ ভাই বা বোন হলেও নয়। এ-ও প্রমাণ করেছিলেন যে আঙুলের ছাপ কোনওদিন পালটায় না। সুতরাং, একবার সংগ্রহ করা মানে তা চিরদিন সংগ্রহে থেকে যাওয়া।
আরও পড়ুন- জাগ্রত মানিকেশ্বের শিব মন্দির, মনস্কামনা পূরণের জন্য ভিনরাজ্য থেকেও ছুটে আসেন ভক্তরা
অর্থাৎ ‘ফিঙ্গার প্রিন্টিং’ হল একরকম বিজ্ঞান। হেনরি, হার্শেল, গলটন– এই ত্রয়ীর দেখানো পথ ধরেই সৃষ্টি হল একাধিক আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করার পদ্ধতি, যা আজও ব্যবহার করছে সারা বিশ্ব। 'Indian Civilization and the Science of Fingerprinting' শীর্ষক তাঁদের বইতে লেখকদ্বয় জিএস সোধি ও জসজিত কাউর প্রস্তাব দেন, ‘Henry’s System of Fingerprint Classification’-এর নাম পালটে রাখা হোক ‘Henry-Haque-Bose System of Fingerprint Classification’. সেই প্রস্তাব গৃহীত না-হলেও ব্রিটেনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি হেমচন্দ্র ও আজিজুলের নামে একটি গবেষণা পুরস্কারের অনুদান দিয়েছে। বহু দশক পরে হলেও, বাংলার এই দুই পুলিশ কর্মীর ভাগ্যে কিছু স্বীকৃতি তো জুটল!