Advertisment

১৯৫২ সালে পোলিং অফিসার, ২০১৯ সালেও ভোটার!

১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শৈলেন্দ্রবাবু শ্যামবাজারে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পান। ২৮ বছরের যুবক সেদিন উত্তেজিত ছিলেন। ৬৭ বছর পর সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলেন বৃদ্ধ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সরশুনার বাড়িতে শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষাল

স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের দিন তিনি পোলিং অফিসারের দায়িত্ব সামলেছেন। সেটা ১৯৫২ সাল। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৮। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে এরপর আরও ১৬টি সাধারণ নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর আসনে নরেন্দ্র মোদী অধিষ্ঠিত হয়েছেন... এবং প্রতিটি নির্বাচনেই ভোট দিয়েছেন অধুনা সরশুনার বাসিন্দা, ৯৫ বছরের শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষাল।

Advertisment

আগামী ১৯ মে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে তিনি ভোট দিতে যাবেন ঠিকই, কিন্তু দেশ ও রাজ্যের বদলে যাওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে অতিবৃদ্ধ মানুষটি বড়ই বিরক্ত।

এ মুহূর্তে শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই হলেও শরীর এখনও সমর্থ। তীব্র দাবদাহের জন্য সকালবেলা বাড়ির বাইরে বেরোতে পারেন না, কিন্তু বিকেল হলেই একবার অন্তত হাওয়া খেয়ে আসা চাই-ই চাই। দেশ ও রাজ্যের রাজনীতির দিকে প্রখর নজর বৃদ্ধ শৈলেন্দ্রনাথের। ভোট দিতে যাবেন কিনা প্রশ্ন করতেই উত্তর এল, "কেন যাব না! নিশ্চয় যাব। এই তো কাছেই আমাদের বুথ। ঠিক পৌঁছে যাব। প্রায় ১০০ বছর বয়স হল, আজ পর্যন্ত দেশে যতগুলি সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, প্রতিটিতে ভোট দিয়েছি। এবারও দেব।”

শৈলেন্দ্রনাথের জন্ম ১৯২৪ সালের ১৫ অগাস্ট। ভবানীপুর এলাকায় তাঁদের পরিবারের অনেকদিনের বাস। হেসে বললেন, “আমার জন্মদিন আর ভারতের স্বাধীবতা দিবস একই তারিখে। অবশ্য আমি যখন জন্মেছি, তখনও স্বাধীনতা অনেক দূরের স্বপ্ন। কয়েক বছর আগে অসহযোগ আন্দোলন শেষ হয়েছে। মধ্য-কুড়ির সুভাষচন্দ্র উঠতি নেতা, তরুণদের আইডল। কংগ্রেসে গান্ধীজির নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত।” তাঁর কথায়, “সে সময় কলকাতা একদম অন্যরকম ছিল। অনেক ফাঁকা, দিব্যি পরিচ্ছন্ন। আমি একদম ছোটবেলায় ভর্তি হয়েছিলাম ভবানীপুর ইন্সটিটিউশনে। তারপর অভয়চরণ বিদ্যামন্দির থেকে ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করি।”

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এরপর শৈলেন্দ্রনাথ ভর্তি হলেন এখনকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় হয় নি, লোকমুখে নাম ছিল যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। তাঁর কথায়, "আমার বিভাগ ছিল ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমার চেয়ে সামান্য সিনিয়র ছিলেন পরবর্তীকালের ভুবনবিখ্যাত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। দেখতাম, হেমন্তবাবু কাঁধে টি ঝুলিয়ে ক্লাস করতে যাচ্ছেন।” পারিবারিক কারণে অবশ্য যাদবপুরে ডিগ্রি শেষ করতে পারেন নি শৈলেন্দ্রনাথ। স্নাতক পাশ করেন সাউথ সিটি কলেজ থেকে, কমার্স নিয়ে।

চাকরিজীবন শুরু হল কোথায়? শৈলেন্দ্রনাথ বলতে থাকেন, “সে সময় কলকাতায় অনেকগুলি নামজাদা সাহেবি কোম্পানির দফতর ছিল। আমি সেই রকম কয়েকটি কোম্পানিতে কিছুদিন চাকরি করি। অবশেষে ১৯৪৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের টেলিকমিউনিকেশন দফতরে চাকরি পাই। তখন আমার বয়স সবে ২০। তারপরের কয়েকটা বছর তো ঝড়ের মতো কাটল। কত কী যে হল! সুভাষবাবু তাঁর আজাদ-হিন্দ ফৌজ নিয়ে যুদ্ধ করলেন, নাবিকরা বিদ্রোহ করলেন, মুসলিম লীগ পাকিস্তানের দাবি তুলল, ছেচল্লিশ সালে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল। অবশেষে সাতচল্লিশ সালের ১৫ অগাস্ট, আমার জন্মের তারিখেই ভারত স্বাধীন হল। আমিও এক লহমায় ব্রিটিশ সরকারের কর্মী থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীতে পরিণত হলাম।”

প্রথম সাধারণ নির্বাচনের দিন শৈলেন্দ্রবাবু শ্যামবাজারের একটি স্কুলে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পান। ২৮ বছরের যুবক সেদিন কিছুটা উত্তেজিত ছিলেন। ৬৭ বছর পর সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলেন বৃদ্ধ, “উত্তেজনা তো কিছুটা ছিলই। আমাদের স্বাধীন দেশের প্রথম ভোট বলে কথা! তার একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের দায়িত্বে আমি, কম কথা তো নয়!” তখন বাংলায় প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল দুটি - কংগ্রেস আর কমিউনিস্ট পার্টি। আরও কিছু দল ছিল, যেমন জনসংঘ, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক। কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী দুই প্রতিপক্ষ - কংগ্রেস আর সিপিআই।

কেমন ছিল প্রথম নির্বাচনে ভোটগ্রহণের অভিজ্ঞতা? নবতিপর শৈলেন্দ্রনাথ বলেন, “আমার কেন্দ্রে চমৎকার ভোট হয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা একে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করছিলেন। কোনও সমস্যা হয়নি। এখন যেমন ভোটকর্মীদের বুথে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়িত্ব সরকার পালন করে, তখন কিন্তু তেমন ছিল না। আমাদের নিজ দায়িত্বেই ভোট করাতে যেতে হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা ভোটগ্রহণ শেষ হলে ব্যালট-সহ যাবতীয় সামগ্রী যথাস্থানে জমা করে বাড়ি ফিরেছিলাম রাত সাড়ে এগারোটায়। আমি তো তখন হা-ক্লান্ত। কিন্তু বাড়ি এসেই সুসংবাদ পেলাম, আমার বোন একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেছেন। ভোটের দিনে জন্ম, তাই নাম রাখা হল ভোটন!”

প্রথম সেই নির্বাচনের পর প্রায় সাত দশক কেটে গিয়েছে। অনেকখানি বদলে গিয়েছে কলকাতা। দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও এসেছে বদল। এই সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নির্বাচনের লড়াই কেমন লাগে? শৈলেন্দ্রবাবুর ভ্রূ কুঁচকে যায় প্রশ্ন শুনেই। এরপর বলেন, “দেখুন, আপনারা এই প্রজন্মের মানুষ। আমার কথাকে ভুল বুঝবেন না। এখন যেভাবে নির্বাচন হয়, সেটি কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর? এই যে দেখছি, দলে দলে সশস্ত্র বাহিনী ভোটের সময় শান্তি বজায় রাখতে আসছে, এসবের প্রয়োজন হবে কেন? আমি তো জানতাম, সশস্ত্র বাহিনী বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে। নির্বাচন তো আমাদের মতপ্রকাশের মাধ্যম। আমরা, আমাদের নেতানেত্রীরা কেন এইটুকু পরিণতিবোধ দেখাতে পারি না, যাতে পারস্পরিক সৌহার্দের ভিত্তিতেই শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হয়!”

তবে এত কিছুর পরও তিনি ভোট দেবেন। ১৯ মে ভোটার স্লিপ হাতে নিয়ে দাঁড়াবেন বুথের লাইনে। কেন? অতিবৃদ্ধ শৈলেন্দ্রনাথ কপালের ঘাম মোছেন। তারপর বলেন, “ভোট না দিলে চলবে? গণতন্ত্রের প্রধানতম ভিত্তি হল নির্বাচন। যতদিন বাঁচব, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করব।” কী ভাবছেন, নির্বাচন কমিশন কেন শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষালকে 'ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর' করছে না?

General Election 2019 election commission
Advertisment