"ফায়ার সিনেমাটা যখন রিলিজ করল, তখন সারা দেশে আগুন জ্বলেছিল। শিবসেনা উগ্র ভূমিকা নিয়েছিল। অথচ কলকাতায় কিছু হয়নি। এরকমটা মনে হতেই পারে, সেটা তো খুবই ভাল ব্য়াপার। কিন্তু আসলে সিপিআইএম-এর পলিসিই ছিল অস্বীকার। ডিনায়াল। কলকাতা শহরে লেসবিয়ান! তেমন কিছুর অস্তিত্ব আছে নাকি! পুরোপুরি এই মোডে চলত তখন কলকাতা সহ এ রাজ্য়।"
কথা হচ্ছিল মীনাক্ষী সান্য়ালের সঙ্গে। মীনাক্ষীকে অনেকে চেনেন বা চিনতেন মালবিকা নামে। নাম পাল্টে সংগঠন তথা আন্দোলনের কাজ করতেন তখনকার সরকারি চাকুরে মীনাক্ষী। যে সংগঠন আর আন্দোলনের জন্য় প্রস্তুতি, পথ চলা, সে আন্দোলন আজ পরিণত, বদলে গেছে তার রূপরেখা। ২০ বছরে পা দিল কলকাতার প্রথম অপর যৌনতার সংগঠন স্যাফো। ২০ বছর আগের লেসবিয়ান-বাইসেক্সুয়াল উওম্য়ান-ট্রান্সম্য়ান রাইটসের সংগঠন, স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি।
বিশ বছরের জার্নি
মালবিকা, থুড়ি মীনাক্ষী স্য়াফোর প্রথম ও প্রধান মানুষ। তাঁর নিজের ওরিয়েন্টেশন সম্পর্কিত স্পষ্ট ধারণা এসেছিল নিজের কলেজজীবনে, ৮-এর দশকের গোড়ায়- মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার একটি লেখা বা ইন্টারভিউ পড়ে। এর পর তিনি আর ফিরে তাকাননি। নিজের ব্য়াপারে স্পষ্ট ছিলেন তিনি। বাকি ছিল কর্মপদ্ধতি স্থির করা। এ ব্য়াপারে গোড়া থেকেই তিনি পাশে পেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গিনী আকাঙ্ক্ষাকে। ফায়ার সিনেমা যখন মুক্তি পায়, তার কিছুদিনের মধ্য়েই একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে প্রকাশিত হয় তাঁর ও তাঁর সঙ্গিনীর সাক্ষাৎকার- ছাইচাপা ফায়ার। সে সময়টা কঠিন। ৩৭৭ ধারা তখন আইনি, দুজনেই সরকারি চাকরি করেন তাঁরা। "তবু এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না", বলছিলেন মীনাক্ষী। "ফায়ার যখন বেরোল, আমরা দুজন সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম, বোঝার চেষ্টা করতাম, আমাদের মত কেউ কি আছে যারা এ সিনেমাটা দেখতে এসেছে! ইন্টারভিউয়ের ব্য়াপারে আমাদের শর্ত ছিল, আমাদের দেওয়া পোস্টবক্স নম্বর প্রকাশ করতে হবে, যাতে এই সাক্ষাৎকার পড়ে কেউ চাইলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। ৩০০ চিঠি এসেছিল, কিন্তু অধিকাংশের সঙ্গেই আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি। মোট ৪০ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা গিয়েছিল।"
তবে তার আগেই আরও কিছু ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আরও দুই লেসবিয়ান কাপলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে তাঁদের। তখনই স্থির হয়েছে ইমোশনাল সাপোর্ট গ্রুপ হিসেবে কাজ শুরু করবে স্য়াফো। সেটা ১৯৯৯ সাল। ২০১৯ সালে স্যাফোর নাম স্য়াফো ফর ইকুয়ালিটি। একটি রেজিস্টার্ড সংস্থা, যাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে, রয়েছে দ্বিভাষিক পত্রিকা, যার নাম- 'স্বকণ্ঠে- ইন আওয়ার ওন ভয়েস' এবং বেশ কিছু প্রকাশনা।
জন্মদিন সেলিব্রেশনের প্রস্তুতি (ছবি- স্য়াফো ফর ইকোয়ালিটি)
স্য়াফোর শুরু থেকেই রয়েছেন শুভাগতা ঘোষ। স্য়াফো প্রকাশিত তিনটি ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের গবেষণার দায়িত্ব সামলিয়েছেন তিনি। স্য়াফোর কুড়িতে পা নিয়ে শুভাগতার কথায়, "কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যাওয়া আমদের ধাতে নেই। তবে নস্টালজিক ত লাগেই। আজকের টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও আমাদের আন্দোলন জারি থাকবে। এক কবির কথা একটু বদলে নিয়ে বলি - সবে কুড়ি বছর গেল, সামনে অনেক রাস্তা বাকি, সমস্ত ঝড় সামলে নেব, সবাই যদি সঙ্গে থাকি।"
শুরুর আগে শুরুর ছবি (কৃতজ্ঞতা- স্য়াফো ফর ইকোয়ালিটি)
মীনাক্ষী বলছিলেন, তাঁরা যখন শুরু করেছিলেন, তখন কোনও কোনও মেয়েদের ঘরে পুরুষ ঢুকিয়ে দিতেন ভাই, লেসবিয়ানিজম ছাড়ানোর জন্য়। কোনও মেয়ের কর্মক্ষেত্রে গিয়ে তাঁর বাবা-মা জানিয়ে দিয়ে আসতেন, মেয়েকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিতে, না হলে অন্য় মেয়েদের সর্বনাশ হবে। সে বিশ বছর আগের কথা।
ব্রেকিং দ্য়া সাইলেন্স (ছবি- স্য়াফো ফর ইকোয়ালিটি আর্কাইভ)
বিশ বছর বয়সে স্য়াফোর কথা যখন জেনেছিলেন মধুরিমা ঘোষ। সেটা ২০০৯ সাল। তাঁর পছন্দের কথা জানতে পেরে তাঁর মায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল রূঢ়। কলেজের সামনেই মধুরিমার পার্টনারের গায়ে হাত তোলেন তিনি। সকলকে নিজের মেয়ের কীর্তি জানাতেও কুণ্ঠা বোধ করেননি। সে সময়ে আরেক বন্ধুর সূত্রে মধুরিমা স্য়াফোর কথা জেনেছিলেন। সেই যে যাতায়াত শুরু হল, তা এখন নাড়ীর যোগে পরিণত। আর যে মায়ের কাছ থেকে সম্পূর্ণ প্রত্য়াখ্য়াত হয়েছিলেন, সেই মা-ই এখন তাঁর সমর্থক। "দিনের পর দিন বুঝিয়েছি, যে এ সারানোর মত কোনও রোগ নয়, এও স্বাভাবিক। মা-ও দেখেছেন আমি ভাল আছি। এখন বাড়িতে থাকি। সবার সঙ্গেই এখন ভাল সম্পর্ক।"