/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/09/COVET-PHOTO-FOOT-PATH.jpg)
ফুটপাতই পুতুলদের ঘর-বাড়ি, অনন্পুত জীবন সংগ্রামের সঙ্গী। ছবি- শশী ঘোষ
কঠিন সে-জীবন। অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে, ময়লা, ধুলোর সঙ্গে শুয়ে আছে যুগ- যুগান্তর! পথেই ওদের জন্ম, বেড়ে ওঠাও সেই পথে। থাকা-খাওয়া, বিয়ে-সংসার সবই হচ্ছে ফুটপাতে। কাগজ কুড়িয়ে, রিকশা-ভ্যান চালিয়ে কিংবা হোটেল বা লোকের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে ওরা। বছরের পর বছর ধরে চলছে কয়েক হাজার ছিন্নমূল মানুষের এই কায়দায় বসবাস। এই শহরের ইতিহাস যেমন বহু পুরনো ঠিক তেমনই পুরনো ফুটপাতে বেঁচে থাকা মানুষের গল্পগুলোও। গরমে হাঁসফাঁশ, এক হাঁটু জলে ডুবে থাকা শহর, অথবা হাঁড় কাঁপানো শীত— আবহাওয়া যেমনই হোক, ওঁদের ঠিকানা বদলায় না। রাজপথ থেকে অলিগলি, ওঁদের আশ্রয় একটাই— ফুটপাত!
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/09/1-INLINE-PHOTO-1.jpg)
না আছে চার ধারে কোনও দেওয়াল, না আছে মাথার উপর ছাদ। খোলা আকাশের নিচেই একটুকরো সংসার পেতে বসে থাকা। আবহাওয়া বিরূপ হলে ভরসা বড়জোর ছেঁড়া-ফাটা একটা প্ল্যাস্টিক। তা-ও সকলের জোটে না। যদিও কলকাতা পুরসভার তরফে ফুটপাতবাসীদের জন্য নৈশাবাসের ব্যবস্থা করা আছে। তবে সেখানে সকলের ঠাঁই নেই। তাই এই শহরে বহু মানুষের এখনও আশ্রয়স্থল ফুটপাত। রীতিমতো প্রাণ হাতে করেই দিন যাপন করতে হয় এই ছিন্নমূল মানুষদের। মাঝেমধ্যেই সরকারি তরফে তাঁদের নামধাম সব লিখে নিয়ে যাওয়া হয়। দেওয়া হয় দিন বদলের প্রতিশ্রুতিও। তার সঙ্গে যদিও বাস্তবের কোন মিল নেই।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/09/1-INLINE-PHOTO-2.jpg)
এতটুকু পড়তে গিয়ে কলকাতা শহরে প্রথম ফুটপাত কোনটি? এ ধরণের প্রশ্ন যদি মনে আসে, তবে রাখা ভালো তথ্য বলছে কলকাতা শহরের প্রথম ফুটপাত তৈরি হয় চৌরঙ্গীতে। ইতিহাস এবং লেখক কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তের বইতে দেওয়া তথ্যে যা জানা যায় প্রায় একশো পঁয়ষট্টি বছর আগে কলকাতায় প্রথম ফুটপাত তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা করেছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির কনজারভেন্সি অফিসার উইলিয়ম ক্লার্ক। পুরসভার ওল্ডারম্যানদের তিনি বুঝিয়েছিলেন, জমা জল থেকে মশা ইত্যাদির মাধ্যমে রোগ ছড়ায়। সেই রোগ ছড়ানো আটকাতে রাস্তার পাশের নর্দমাগুলোকে পাকা করা হলেও সেই উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হবে যদি না কংক্রিট দিয়ে সেগুলোকে ঢাকা দেওয়া হয়। আর পথচারীরা সেই ঢাকা দেওয়া নর্দমার উপর দিয়ে দিব্যি হাঁটতে পারবেন। সেটাই হবে ফুটপাত। তখন কে জানতো হাঁটার পাশাপাশি অনেকের বাসস্থান হয়ে উঠবে কংক্রিটের ঢাকা দেওয়া এই জায়গাগুলো। কলকাতার বহু ফুটপাতের মধ্যে এমনই এক ফুটপাত হল আমহার্স্ট স্ট্রিট। এখানেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রয়েছে অনেক মানুষ।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/09/1-INLINE-PHOTO-3.jpg)
"ষাট সত্তর বছর আগে বাপ ঠাকুরদা দেশের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসেছিল কাজের খোঁজে। তারপর থেকে এখানে ঠাঁই। বাবা, মা এখানেই মারা গেল। আমার বিয়ে সন্তান সব এখানেই। গ্রামে চাষবাস করতে পারিনা ছোট থেকে ফুটপাতেই মানুষ হয়েছি। আমার চার ছেলে মেয়ে। ওরাও থাকে ফুটপাতে।" কাজ করতে করতে বলছিলেন, মঙ্গলা সর্দার। রাস্তার একধারে বসে রান্নার জন্যে সরঞ্জাম জোগাড়ে ব্যাস্ত তিনি। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। লোকের বাড়িতে কাজ করেন। মঙ্গলার মতন আরও অনেকগুলো পরিবার এই রাস্তাতেই রয়েছে। দিন কয়েক হল ফুটপাত সৌন্দর্যায়নের জন্যে অনেক মানুষকে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাতের বেশীরভাগ মানুষই দক্ষিণ বারাসাত এবং ক্যানিং থেকে বহু বছর আগে এসে থাকতে শুরু করেছিলেন। তারপর থেকে এটায় ওদের ঠিকানা। আমহার্স্ট স্ট্রিট এবং মহাত্মা গান্ধী রোডের ক্রসিংয়ের ধারে থাকেন পিঙ্কি দাস। পিঙ্কির বয়স সাতাশ বছর। পিঙ্কির কথায়," জন্ম আমার উলটো দিকের ফুটপাতে। শিয়ালদাহ থেকে যে রাস্তাটা মহাত্মা গান্ধির দিকে যাচ্ছে ওই দিকটায়। অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছি। ঝড় জলে আমহার্স্ট স্ট্রিট এমনিতেই জলের নীচে চলে যায়। গলা অব্দি জলের মধ্যে বাসনপত্র সব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ছোটবেলায় স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু অভাবের কারণে বাবা কাগজ কুড়াতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর পড়াশুনা করা হয়নি। এখানেই প্রেম ভালবাসা করে বিয়ে। এখন স্বামী সংসার, বাচ্চা কাচ্চা সব একই জায়গাতেই আছি। সরকারের তরফ থেকে কোনরকম সাহায্যে পায়না। আমাদের জন্যে পুরসভা থেকে ঘর করা হয়েছে বলে শুনেছি কিন্তু আমরা কিছুই পায়নি। ভোট আসলে আমাদের কাছে তখন সব দল হাত জোড় করে চলে আসে। ভোট চলে গেলেই সব ফাঁকা।"
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/09/1-INLINE-PHOTO-4.jpg)
রাস্তার ধারে বন্ধ দোকানের সাটারে সামনে দড়িতে ঝুলছে জামা কাপড়। নীচে ঠেস দিয়ে রাখা বালিশ। ছেঁড়া কাপড়, পোঁটলা। এদিক সেদিক ছড়ানো ছেটানো খাবারের থালা বাসন। রাস্তাতেই বসে খেলছে শিশুরা। একধার দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি। অসুরক্ষিত জীবনযাপনেই যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এরা। দিনের আলোতে বাথরুমে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। পাবলিক টয়লেটে ব্যবহার করতে টাকা লাগে। অনেক সময় মলমূত্রের জন্যে ড্রেনের ওপরেই ভরসা করে থাকেন। শিশু সন্তানদের সব সময় স্নান করানো সম্ভব হয় না। তিন চারদিন পরে স্নানের সুযোগ পেলে ভেজা কাপড় দিয়ে সন্তানদের শরীর মুছিয়ে দেন। ফুটপাতের বেশীরভাগ শিশুরাই নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত। নারী-পুরুষদের মধ্যে শারীরিক অসুস্থতা লেগেই আছে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/09/1-INLINE-PHOTO-5.jpg)
পুরসভার তথ্য মতে আশ্রয়হীন, ভবঘুরে ও ফুটপাতবাসীদের জন্য কয়েক বছর আগে নৈশাবাস তৈরি করা শুরু করে। পুরসভা সূত্রের খবর, শহরের বিভিন্ন এলাকায় এমন অনেক নৈশাবাস তৈরি করা হয়ে আছে। সেখানে সম্পূর্ণ নিখরচায় রাত কাটানোর ব্যবস্থা থাকলেও অনেকেরই ঠাঁই হয় না। তাঁদের রাত কাটে সেই ফুটপাতেই। প্রায় ৮০ বছর ধরে ফুটপাথের ওপর বাস পুতুলের পরিবারের। বংশপরম্পরায় আমহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাতেই মানুষ। জয়নগরের এক ভ্যানওয়ালার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্বামীর অত্যাচারে থাকতে না পেরে পুনরায় মাথা গোঁজার ঠিকানা সেই ফুটপাত। সপ্তাহখানেক হল আমহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাতের থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তার ছেলেমেয়েদের। এখন মহাত্মা গান্ধী রোডের উপরেই প্ল্যাস্টিক টাঙ্গিয়েই রয়েছে। তার কাছে পুরসভার থেকে দেওয়া বাসস্থানের ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই বললেন, "ওখানে আমাদের কোন জায়গা নেই। লাল পার্টি যখন ছিল তখন একটু আধটু সুযোগ সুবিধে পাওয়া যেত। এখন কিছুই পায়না। পার্টির দাদারা নিজেদের লোকজনকে সেখানে রাখেন। কয়েকদিন আগে পার্টির মঞ্চ বেঁধেছিল এখানে আমার ছেলেটা দাঁড়িয়ে শুধু দেখছিল। ওখানে একজন কোমরে এমন একটা লাথি মারল, রাস্তায় ছিটকে এসে পড়ল আমার বাচ্চাটা। ভোট এলেই তখন আমাদের কাছে ওরা চলে আসে। কতরকম যে কথা বলে! ভোট গেলেই আমাদের সাথে কুকুরের মতন ব্যবহার করে। কীভাবে যে বেঁচে আছি বলে বোঝানো যাবে না। একদিকে মানুষের ভয় আরেক দিকে গাড়ি এসে মেরে দেওয়ার। আমাদের বেঁচে থাকার ভরসা তো একটাই, তা ফুটপাত।"