ছেলেবেলা থেকেই ছিল মানুষের দাঁড়ানোর তাগিদ। ইচ্ছা থাকলেও পড়াশুনা বেশিদূর করা সম্ভব হয়নি। অভাব ছিল পরিবারের নিত্যসঙ্গী। ২০১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সংসারের হাল ধরতেই জোগাড়ের কাজ শুরু কুলতলির পুলকের। বৃদ্ধ বাবা আর অসুস্থ মা সংসারের হাল ধরা ছাড়া বিকল্প কোন পথও খোলা ছিল না পুলকের কাছে। কুলতলির পুলক তার অসামান্য কাজের জন্য আজ সংবাদ শিরোনামে। জোগাড়ের কাজ করেই খুলে ফেলেছেন আস্ত এক পাঠশালা। পড়ুয়ার সংখ্যা নেহাতই কম হয়। প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের ৪৬ জন পড়ুয়া হাতে কলমে শিক্ষার পাঠ নেয় পুলকের এই পাঠশালায়।
কুলতলির দেউলবাড়ির যুবক পুলক মণ্ডল। পড়ুয়া পিছু দিনে মাত্র এক টাকা করে নিয়ে টানা ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে চালাচ্ছেন এই পাঠশালা। প্রথমে নিজে শুরু করলেও পরে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকাও বর্তমানে তিন জন শিক্ষিকাও রয়েছে পুলকের এই পাঠশালায়। তাদের যৎসামান্য হলেও পারিশ্রমিক দেন পুলক। বাড়ির অদূরে ‘বাগানবাড়ি’তেই গড়ে তুলেছেন স্বপ্নের এই পাঠশালা। যদিও এই পাঠশালার পোশাকি নাম ‘স্বামীজী পাঠশালা’ তাও গ্রামের সকলের কাছে ‘এক টাকার পাঠশালা’ নামেই পরিচিত পুলকের এই স্কুল। পড়াশুনার পাশাপাশি নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারও পড়ুয়াদের পরিবেশন করা হয়। সেই সঙ্গে বছরে দু’বার দেওয়া হয় নতুন পোশাকও।
নিজের সাধের এই পাঠশালা প্রসঙ্গে পুলক জানিয়েছেন, “ছোট থেকেই মানুষের পাশে থেকে মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। নিজের ইচ্ছা থাকলেও সেভাবে পড়াশুনা করে উঠতে পারিনি। ২০১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর সংসারের হাল ধরতে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে ঢোকা। সেখান থেকে যা আয় হয় তা বাঁচিয়ে গ্রামের কচিকাঁচাদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। যেহেতু গ্রামগঞ্জে সুযোগ-সুবিধা শহরের তুলনায় অনেকটাই কম, আর অভাবের কারণে অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, তাই তাদের সকলের কথা ভেবেই আমার এই পাঠশালা গড়ে তোলা। এখন প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ৪৬ জন পড়ুয়া এই পাঠশালায় নিয়মিত পড়াশুনা করে। সামনের বছরে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণি যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে”।
পুলক আরও জানিয়েছেন, “ পাঠশালার ৪৬ শিশুকে সমস্ত রকমের শিক্ষা সামগ্রী, পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার পাশাপাশি দেউলবাড়ী এলাকায় দুস্থ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় এবং এলাকায় গরীব মানুষদের কমবেশি রেশনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।এছাড়াও স্বামীজীর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কুলতলী বিভিন্ন গ্রামে শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষার সামগ্রী দেওয়ার হয়।এমনকি দুর্গা পূজা উপলক্ষে পাঠশালার শিশুদের নিয়ে কুলতলীর সেরা প্রতিমা ও প্যাণ্ডেলগুলি ঘোরানো খাওয়া দাওয়া করানো হয়”। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ পুলকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। পুলকের কথায়, ‘আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে সারাজীবন মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই। এটাই আমার ইচ্ছা’।