এক মমতা থাকেন নবান্নে। সেখানে থেকে নজর রাখেন বাংলার অলিগলিতে। আর রবীন্দ্র সরোবর দেখাশোনা করেন তাঁর এক রেপ্লিকা। আচরণগত সাদৃশ্যের জেরে লোকমুখে তাঁর নাম - 'লেক মমতা!'
প্রতিদিন সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে ভরদুপুর পর্যন্ত রবীন্দ্র সরোবরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত টহল দেন বছর পঞ্চাশের সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ভোটার কার্ড বা আধার কার্ডের বাইরে পিতৃদত্ত এই নামে প্রায় কেউই ডাকেন না তাঁকে। সরোবরে নিয়মিত আসা প্রাতঃভ্রমণকারী থেকে শুরু করে টহলদার পুলিশ, ব্যবসায়ী, এমনকি ভিক্ষুকদের কাছেও তিনি 'লেক-মমতা।'
কেন এমন নাম? সরোবরের নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণকারী, পেশায় ব্যবসায়ী অমিতাভ রায়ের কথায়, ''প্রতিদিনই সুমিতাদেবীকে দেখা যায়, হাতে একটা লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ জলে নামছে কিনা, কেউ কাপড় কাচছে কিনা, জলে কোনওরকম আবর্জনা ফেলা হচ্ছে কিনা - সবদিকেই তাঁর কড়া নজর। কেউ নিয়ম ভাঙলেই কপালে জুটবে ওঁর তিরস্কার। পুলিশের কর্মী, আধিকারিকরাও ওঁকে রীতিমতো সমঝে চলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন খানিকটা একরোখা আচরণের জন্য পরিচিত, আমাদের লেক-মমতাও তেমন। সরোবরের কোনও ক্ষতি উনি সহ্য করবেন না। সকলেই ওঁকে ওই নামেই ডাকি। সরোবর ওঁর প্রাণ। বছরের পর বছর নিজের উদ্যোগে যা করছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।''
'লেক-মমতা' থাকেন রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে। শনিবার যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হল, তিনি জলে কাপড় কাচার সময় এক মহিলাকে হাতেনাতে ধরেছেন। প্রথমে তিরস্কার, তারপর নীচু গলায় বোঝানোর পর ওই মহিলা রীতিমতো ক্ষমা চেয়ে লেক ছাড়লেন। ততক্ষণে 'লেক-মমতা' সুমিতাদেবীর চারপাশে ভিড় জমে গিয়েছে। লেক গার্ডেন্সের বাসিন্দা, প্রবীন অনাথবন্ধু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ''এই ধরনের কাজ উনি রোজ করেন। ৩৬৫ দিন - কোনও কামাই নেই। ইনি আছেন বলে লেকটা এখনও কিছুটা হলেও ভাল আছে। প্রতিদিন সকাল থেকে উনি নিজের উদ্যোগে নজরদারি করেন, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। আমরা ওঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।''
সুমিতাদেবী জানান, তিনি নিয়মিত সরোবরে আসছেন প্রায় দেড় দশক। প্রথমে নিছক প্রাতঃভ্রমণকারী হিসাবেই আসতেন। তাঁর কথায়, ''তারপর কেমন করে যেন ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লাম। আমি বিয়ে করি নি। এখন এই সরোবরটাই আমার জীবনের সবকিছু হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন কাকভোরে চলে আসি। গোটা লেক চক্কর দিই। কোথাও কিছু বেনিয়ম হচ্ছে কিনা দেখি। নিজের সাধ্যের মধ্যে হলে সামলাই, নাহলে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে জানাই।''
'লেক-মমতা' নামটা কবে থেকে হল? সুমিতা বলেন, "আমি নিজেও জানি না। বেশ কয়েক বছর আগে একদিন লেকের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, দেখি কয়েকজন আমাকে 'লেক-মমতা' বলে ডাকছেন। আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছি। ওঁরা জানালেন, অনেকদিন ধরেই আমাকে নাকি আড়ালে ওই নামে ডাকা হয়। আমি ভাবলাম, বেশ তো! আড়াল আবডালের তো কিছু নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক বড় মাপের ব্যক্তি, কেউ যদি সাদৃশ্য খুঁজে পান, তাতে সমস্যা নেই। এখন সকলেই আমায় হয় দিদি অথবা 'লেক-মমতা' বলেই ডাকেন।"
লেক-মমতা আরও জানান, সরোবর নিয়ে কাজ করে তিনি মানুষের অপরিসীম ভালবাসা পেয়েছেন। কিন্তু সরোবরের পরিস্থিতি ভাল নয়। কারণ জানতে চাইলে কিছুটা উত্তেজিত সুমিতাদেবী। তাঁর কথায়, ''কিছুই তো ঠিকভাবে হচ্ছে না! সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে, সরোবরের একদম গায়ে কংক্রিটের রাস্তা তৈরি করা যাবে না। কিন্তু সে সব মানার তো বালাই নেই! এমনকী, গাছের গুঁড়িগুলোও সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।'' এই নিয়ে ইতিমধ্যেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন 'লেক-মমতা' ও তাঁর সঙ্গীরা।
সরোবরে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরাও সুমিতাকে 'লেক-মমতা' বলেই ডাকেন। লেক থানার এক পুলিশকর্মীর কথায়, ''ওঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিত্বের একটা মিল আছে। উনি আমাদের সাহায্যও করেন। সাধারণ মানুষ এভাবে এগিয়ে এলে খুবই ভাল।''