Land Mafia in Maldah: জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য এত বাড়ছে কেন! ৫০টা অভিযোগের মধ্যে ৩০টা অভিযোগই জমি সংক্রান্ত। বিতর্কিত জমি থাকলেই দলের একাংশ জনপ্রতিনিধিরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে। টাকার খেলা চলছে। এগুলি একেবারে বরদাস্ত করা হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ দিয়েছেন সরকারি জমি উদ্ধার করুন। জলা জমি ভরাট বন্ধ করুন। মঙ্গলবার দুপুরে জেলা কালেক্টরেট বিল্ডিং-এ প্রশাসনিক বৈঠকে রীতিমতো বিএলআরও'দের কড়া ভাষায় ধমক দিয়েছেন রাজ্যের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফরের প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন।
এদিনের বৈঠকে মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনের পাশাপাশি উপস্থিত হয়েছিলেন মালদা জেলা পরিষদের সভাধিপতি লিপিকা বর্মন ঘোষ, অতিরিক্ত জেলাশাসক তথা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের আধিকারিক দেবাহুতী ইন্দ্র-সহ মালদা জেলার ১৫টি ব্লকের বিএলআরও এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের পদস্থ কর্তারা। বৈঠকের শুরুতেই রীতিমতো কড়া ভাষায় সুর চড়িয়েছেন মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁর অভিযোগ, 'শহর থেকে গ্রাম যেখানে সেখানে জলাশয় বুঝিয়ে ফেলা হচ্ছে। মালদা শহরের জলাশয় বুঝিয়ে একের পর এক বহুতল গড়ে উঠছে। গ্রামেও মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছে। একাংশ পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিরা মানুষের সেবা ছেড়ে জমি ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। প্রতিদিনই ভুরি ভুরি অভিযোগ জেলা প্রশাসনের কাছে আসছে। তার মধ্যে সিংহভাগই রয়েছে জমি সংক্রান্ত বিষয়। বিএলআরও'রা যেখানে রেকর্ড নামা থেকে শুরু করে পরচা এবং জমি সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করেন। এখন অনেক সময় দেখা যাচ্ছে অসহায় মানুষ জমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পুলিশ ও নেতাদের কাছে ছুটছে। তাহলে আপনারা কীসের জন্য। এগুলো বরদাস্ত করা যাবে না। মালদার সমস্ত রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর নজরে রয়েছে। মালদা জাতীয় সড়কের ধার ধরে বিভিন্ন এলাকায় যেভাবে মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে, তা বন্ধ করার চেষ্টা করুন।'
এই দিনের বৈঠকে মূলত ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিকদের নিয়ে সরকারি জমির জবরদখল উদ্ধার, জলা জমি সংস্কার, রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো-সহ একাধিক ইস্যু বিষয়ে প্রশাসনিক বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকের শুরুতেই বিভিন্ন ব্লকের বিএলআরও'রা নিজেদের সংগৃহীত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ সম্পর্কে বলতে শুরু করেন। কোথায় কীভাবে জলাজমি সংস্কার এবং ভরাট বন্ধের অভিযান চালানো হচ্ছে, সেগুলোর খতিয়ানও তুলে ধরা হয়। কিন্তু এই কথা শোনার পরেই রীতিমতো চটে যান মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন।
মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, 'চলতি অর্থবর্ষে সংশ্লিষ্ট দফরের রাজস্ব আদায় বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু বেআইনিভাবে পুকুর, জলাজমি ভরাট বন্ধ হচ্ছে না। কালিয়াচকের সমস্ত এলাকার জলাজমি বুঝিয়ে ফেলা হচ্ছে। পুরাতন মালদায় ৩৯ নম্বর জাতীয় সড়ক এবং বাইপাস রোডের ধার ধরে জলাজমি ভরাট চলছে। কী করছেন আপনারা? মালদার ইংরেজবাজার শহরের জলাজমি ভরাট করে বহুতল নির্মাণ হচ্ছে। শহর থেকে গ্রামের একাংশ জনপ্রতিনিধিরা মানুষের কাজ ছেড়ে জমির ব্যবসায় যুক্ত হয়ে পড়েছেন। প্রতিদিনই এত বিপুল পরিমাণ অভিযোগ আমার কাছে আসছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিন বৈঠকের পর আমি ডিএম সাহেবের নজরে এনেছি। জমি সংক্রান্ত বেআইনি কাজ কোনওভাবে বরদাস্ত করা হবে না। কোনওরকম বিতর্কিত জমিতে পঞ্চায়েত প্রধান হোক বা শহরের জনপ্রতিনিধিরা, মাথা ঘামাবেন না। তার জন্য আইন ও প্রশাসন আছে। সরকারি জমি যেসব জায়গায় দখল হয়েছে অবিলম্বে সেগুলো উদ্ধার করুন। জলাজমি এবং পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান চালান। জমি সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ এরপর আসলে সেই ব্লকের বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নালিশ যাবে।'
আরও পড়ুন CBI Raid: নিট কাণ্ডে নাম জড়াল কলকাতার, নিউটাউনের আবাসনে হানা সিবিআইয়ের
অতিরিক্ত জেলাশাসক তথা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের আধিকারিক দেবাহুতি ইন্দ্র বলেন, এদিন জমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সমস্ত বিএলআরওদে'র উপস্থিতিতে বৈঠক করেছেন মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। সেখানে রেভিনিউ বাড়ানো, জমির রেকর্ড, পরচা সুষ্ঠুভাবে তৈরি করা, বিভিন্ন জমি সংক্রান্ত বিষয়ে নাগরিকদের স্বাভাবিক পরিষেবা দেওয়ার বিষয়গুলি আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি যেসব সরকারি জমি জবরদখল হয়ে রয়েছে, সেগুলি পুনরুদ্ধার করা ও জলাজমি ভরাটের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর বিষয় নিয়ে এদিন বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিটি ব্লকের রেভিনিউ অফিসার এবং রেভিনিউ ইন্সপেক্টর যারা রয়েছেন, তাঁরা প্রতিটি সরকারি জমি এবং জলাজমি ভরাটের বিষয়ে নজরদারি চালাবে। তারপর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে যেখানে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রীতিমতো কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ঠিক তার উল্টোদিকেই মালদার কালিয়াচকে মধ্যবিত্ত এক পরিবারের ৩৫ কাঠা জমি জোর করে দখলের অভিযোগ উঠল তৃণমূল দলের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে। ইঁটভাটা তৈরির নাম করেই গৃহস্থের জমি রীতিমতো দাদাগিরি মেরেই দখল করছে স্থানীয় জমি মাফিয়ারা বলে অভিযোগ। ঘটনাটি ঘটেছে কালিয়াচক থানার রাজনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভবানীপুর এলাকায়। ইতিমধ্যে ওই জমির মালিক পোদ্দার পরিবার কালিয়াচক থানার আইসি থেকে শুরু করে পুলিশ সুপার, জেলাশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ কোনও সহযোগিতা না করাই অবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে অভিযোগ জানানোর দাবি করেছেন কালিয়াচকের পোদ্দার পরিবারের সদস্যরা।
উল্লেখ্য, দলের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সামনে আসতেই রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছে জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূলের জেলার সহ-সভাপতি শুভময় বসু জানিয়েছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে দল কোনওভাবেই পাশে থাকবে না।
আরও পড়ুন ED: খাদ্য দুর্নীতি মামলায় ফের সক্রিয় ইডি, শাহজাহানের কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত তথ্য পেতে বিরাট পদক্ষেপ
প্রসঙ্গত, কালিয়াচক থানার রাজনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের বালিয়াডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা, প্রদীপ পোদ্দার, অমিত পোদ্দারের পরিবার ভবানীপুরে ২০২২ সালে ৩৫ কাটা জমি কিনেন। সেখানেই তাদের একটি কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরেই পোদ্দার পরিবারের জমি জোর করে দখল করার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় কিছু জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে। আর এই ঘটনায় তৃণমূল পরিচালিত রাজনগর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী বারজাহা শেখ সহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
ওই জমির মালিকের এক সদস্য প্রদীপ পোদ্দার বলেন, 'আমাদের পরিবারের চার সদস্যদের নামে ৩৫ কাঠা জমি বহুদিন আগে নেওয়া হয়েছিল। এখন সেই জমির অর্ধেক অংশই স্থানীয় জমি মাফিয়ারা দখল করে নিচ্ছে। রীতিমতো এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামীর দাঁড়িয়ে থেকে জমি দখলের কাজ করাচ্ছে। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এইসব ঘটনার বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কড়া হাতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানেই স্থানীয় তৃণমূল নেতা দাদাগিরি করেই আমাদের জমি দখল করছে। প্রতিবাদ করাতে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। কালিয়াচক থানায় অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। তাই এখন মুখ্যমন্ত্রীর দুয়ারে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।'
জমির অপর আরেক মালিক অমিত পোদ্দার বলেন, 'পুলিশ ও প্রশাসনের সমস্ত জায়গায় অভিযোগ করেছি। যেহেতু তৃণমূল গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামীর নামে অভিযোগ, তাই পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ওরা ইঁটভাটা তৈরির নামে আমাদের জায়গা ঘিরে নিচ্ছে। সেখানে ইতিমধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু করে দিয়েছে। মঙ্গলবার মালদায় প্রশাসনিক বৈঠকে মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন জমি দখলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তারপরও এই অবস্থা। আমাদের এখন মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।'
এদিকে এই ঘটনার পর রাজনগর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামীর সঙ্গে কোনওরকম ভাবে যোগাযোগ করা যায়নি। তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি শুভময় বসু বলেন, 'এই ধরনের ঘটনার অভিযোগ তদন্ত করে দেখার জন্য পুলিশ ও প্রশাসন রয়েছে। তবে অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে দল কখনোই এমন মানুষদের পাশে থাকবে না।'
বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক অম্লান ভাদুড়ি বলেন, 'এক শ্রেণির তৃণমূলের নেতারা অসহায় মানুষের জমি দখল করছে। মানুষকে হয়রানি করে ইনকাম করার মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কালিয়াচকের ঘটনা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যাতে পুলিশ ও প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।'