Advertisment

কুস্তি-দোস্তি সবই কথার কথা, আসল লক্ষ্য ক্ষমতাই, পঞ্চায়েতের পর বাংলা ছেয়েছে রামধনু জোটে

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বিশেষ প্রতিবেদন।

IE Bangla Web Desk এবং Chinmoy Bhattacharjee
New Update
Panchayat Election

গোপাল কোলে (ডানে), টিএমসি থেকে নবনির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রধান, তাঁর ডেপুটি বিজেপির শুভঙ্কর গণরার সঙ্গে হাওড়া জেলার বাসুদেবপুরে তাঁদের গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ফ্রেমবন্দি ছবিও দেখা যাচ্ছে। (এক্সপ্রেস ছবি- পার্থ পাল)

গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের একটি ঘরে মহাত্মা গান্ধী, বিআর আম্বেদকর এবং অন্যান্যদের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাশাপাশি মমতা ব্যানার্জি এবং নরেন্দ্র মোদীর ফ্রেমবন্দি ছবিগুলো পাশাপাশি ঝুলছে। নীচের চেয়ারে গোপাল কোলে, তৃণমূল কংগ্রেস থেকে নবনির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রধান এবং তাঁর ডেপুটি শুভঙ্কর গণরা। যিনি আবার রাজ্য বিজেপির। এই চির প্রতিদ্বন্দ্বীরা হাওড়ার বাসুদেবপুরে গ্রাম পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনের জন্য হাত মিলিয়েছিলেন। এটি এমন এক রাজ্যের এক অদ্ভূত দৃশ্য, যা সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে পক্ষপাতদুষ্ট রাজনীতির সাক্ষী হয়েছে। এখানে শাসক টিএমসি এবং বিরোধী দল বিজেপি সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচন-সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এই রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে বড় রক্তপাত দেখেছে। তবুও, ক্ষমতায় থাকার সুবাদে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের হাত ধরতে বাধ্য হয়েছে।

Advertisment

বাসুদেবপুর, কলকাতা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে, বাংলার কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্যতম। যেখানে জাতীয় ও রাজ্যস্তরের দলগুলোকে বিভক্ত করার লাইন অত্যন্ত স্পষ্ট। এমন এক জায়গায় চির প্রতিদ্বন্দ্বীরা পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনের জন্য একত্রিত হয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে যেখানে টিএমসি এবং বিজেপি হাত মিলিয়েছে, তার অন্যতম এই বাসুদেবপুর। যেখানে 'দুর্নীতিবাজদের' ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে এবং জনগনের (জনগণের) পঞ্চায়েত স্থাপনের লক্ষ্যে তাঁরা হাত মিলিয়েছেন বলে প্রার্থীরা দাবি করেছেন। জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধীদের সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫৫ জন নিহত হয়েছিল। রাজ্যের ৪৮,৬৪৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস একতরফা ভাবে ৩৮,১১৮টি আসনে জিতেছে। বিজেপি জিতেছে ৫,৭৭৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতে। সিপিএম জিতেছে ১,৪৮৩টি এবং কংগ্রেস ১,০৬৬টি পঞ্চায়েতে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর এবং নদীয়া জেলাজুড়ে এরকম চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত পরিদর্শন করেছে।

হাওড়া
গোপাল কোলে বলেন, 'আমরা সচেতন যে আমরা চিরশত্রু। কিন্তু, এটা জনগণের ইচ্ছা ছিল যে আমরা একটি (জনগণের) পঞ্চায়েত গঠন করি। এই জোট টিএমসির মধ্যে দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতা দখল থেকে বাঁচানোর জন্য গঠিত হয়েছিল।' ৩৬ বছর বয়সি কোলে গ্রামে টেলিভিশন মেরামতির দোকানের মালিক। বাসুদেবপুরে, যেখানে ২০,০০০-এর বেশি জনসংখ্যা এবং প্রায় ১২,০০০ ভোটার, পঞ্চায়েত ভোটের সময় টিএমসি ১৩টি, বিজেপি ৬টি এবং ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) একটি আসনে জিতেছিল। যদিও কোলে টিএমসির প্রচারের মুখ ছিলেন, বোর্ড চলাকালীন একটি ভিন্ন নাম কিন্তু প্রস্তাব করা হয়েছিল। ১১ আগস্ট বোর্ডের গঠন। কোলে বলেন, 'টিএমসি প্রধানের জন্য অন্য কারও নাম প্রস্তাব করার পরে, আমরা চার জন (টিএমসি থেকে বিজয়ী প্রার্থী) বিজেপির সমর্থন চেয়েছিলাম। প্রাথমিকভাবে কিছু অনিচ্ছা দেখানোর পরে তারা আমাদের সমর্থন করেছে।'

গণরা, একজন প্রাথমিক শিক্ষক। তিনি যোগ করেছেন, 'আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত টিএমসি নেতাদের ক্ষমতা দখল করা থেকে বিরত রাখা। কোলে একজন সৎ মানুষ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে দলগুলো হাত মিলিয়েছে, তা কিন্তু নয়। আমরাই গ্রাম পঞ্চায়েতের সেবা করার জন্য পরস্পরের হাত ধরেছি। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে বাসুদেবপুর গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল। কোলে এবং গণরার পাশে বসে বিজেপির বিজয়ী প্রার্থী দিলীপ মাইতি বলেন, 'রাজনীতিতে সবকিছুই সম্ভব।' মাইতি যোগ করেন, 'যদিও আমরা পঞ্চায়েত নির্বাচনে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রচার করেছি, আমাদের জোট জনগণের জন্য তৈরি হয়েছিল। আমরা আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে এবং বিধানসভা নির্বাচনেও টিএমসি-র বিরুদ্ধে প্রচার চালাব।' তবে, সবাই এই অস্বাভাবিক রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে একমত হননি। টিএমসি যুব ব্লক সভাপতি সত্যজিৎ মণ্ডল দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, 'আমি মনে করি প্রত্যেকেরই দলীয় নিয়ম মেনে গ্রাম পঞ্চায়েতের জন্য দলের দ্বারা নির্বাচিত প্রার্থীকেই নির্বাচিত করা উচিত।'

পূর্ব মেদিনীপুর
বাসুদেবপুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট ব্লকের বৈষ্ণবচক গ্রাম পঞ্চায়েতে, বিজেপি এবং সিপিআইএম বোর্ড গঠনের জন্য হাত মিলিয়েছে। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে টিএমসি ৮টি, বিজেপি ৪টি, সিপিআইএম ৫টি, নির্দল ৩টি, কংগ্রেস ১টি এবং আইএসএফ ১টি আসন জিতেছে। শিবনাথ সামন্ত, একজন নির্দল, যিনি ২০ জুলাই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, তিনি হলেন গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। যদিও সিপিআইএমের রুকশেহনাজ পারভিন বেগম প্রধান হয়েছেন। তিনি এবং তাঁর স্বামী মইদুল মালিদা উভয়ই ভোট-পরবর্তী জোটের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। সামন্ত দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, 'ফলাফলের পরে, বিজেপি এবং সিপিআইএম উভয়েরই একটি এজেন্ডা ছিল- দুর্নীতিগ্রস্ত টিএমসিকে গ্রাম পঞ্চায়েত দখল থেকে বিরত রাখা।'

publive-image
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট ব্লকের বৈষ্ণবচক গ্রাম পঞ্চায়েতে, সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে নির্দল প্রার্থী শিবনাথ সামন্ত বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁর উপপ্রধান সিপিআইএমের। (পার্থ পালের এক্সপ্রেস ছবি।)

সামন্ত, যিনি ২০১০ সাল থেকে সিপিআইএমের সঙ্গে ছিলেন এবং স্থানীয় ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (ডিওয়াইএফআই) কমিটির সেক্রেটারি, তিনি বলেছেন, 'সিপিআইএম আমাকে সমর্থন করতে রাজি হয়নি। কারণ আমি নির্দল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলাম। যেহেতু বিজেপি আমাকে সমর্থন করতে রাজি হয়েছে, তাই আমি জয়ের পর দলে যোগ দিয়েছি।' তিনি যোগ করেন, 'যদিও আমি একজন বামপন্থী, কিন্তু একজনকে বেঁচে থাকার কথাও তো ভাবতে হবে। আমি যখন 'ইন্ডিয়া'য় (জাতীয় বিরোধী জোট) বাম এবং টিএমসি নেতাদের একসাথে দেখি, তখন আমি এই জোটকে কিছুতেই মানতে পারি না। কারণ, টিএমসি কর্মীরা এখানে আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।'

নদিয়া
কলকাতা থেকে প্রায় ১১৩ কিলোমিটার দূরে, নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর-১ ব্লকের দিগনগর গ্রাম পঞ্চায়েতে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পরিদর্শনের সময় এখানে বিজেপির চার জন বিজয়ীর মধ্যে দু'জনকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। সিপিএমের ১০ জন বিজয়ীর মধ্যে পাঁচ জন, যার মধ্যে প্রধান এবং উপপ্রধানও ছিলেন। ২২টি আসনের মধ্যে সিপিএম ১০টি, টিএমসি ৮টি এবং বিজেপি ৪টি আসন পেয়েছে। যদিও বিজেপি বোর্ড গঠনের সময় ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।

publive-image
দিগলি বিশ্বাস সরকার (সরকার), প্রধান এবং একজন সিপিএম সদস্য। দিগলি প্রথমবারের প্রার্থী। নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর ১ ব্লকের দিগনগর গ্রাম পঞ্চায়েতে উপপ্রধান সমীর দেবনাথের (সিপিএম) সঙ্গে বসে আছেন। (এক্সপ্রেস ছবি পার্থ পাল)

প্রধান এবং প্রথমবারের প্রার্থী দিগলি বিশ্বাস সরকার বলেন, 'কোনও বোঝাপড়া ছিল না (সিপিএম এবং বিজেপির মধ্যে)। বিজেপির ভোটদানে বিরত থাকা আমাদের টিএমসি-র বিরুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করেছে। আমরা বিজেপির সঙ্গে কাজ করব। কারণ, এলাকার উন্নয়নের জন্য তাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে আমাদের। সিপিএম-এর ৩০ বছর বয়সি নেতা শুভঙ্কর কর্মকার বলেন, 'বিজেপি যদি বোর্ড গঠনের জন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দিত, তবে ভাল হত। এটাই বাস্তব রাজনীতি।'

দিগনগর গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে প্রায় ৩৫ কিমি দূরে নদিয়ার চোপড়া ব্লকের কলিঙ্গ গ্রাম পঞ্চায়েত। ৩০টি আসনের মধ্যে, বিজেপি এবং টিএমসি পঞ্চায়েত নির্বাচনে ১৩টি করে এবং সিপিএম ৮টি আসন জিতেছে। প্রধান উৎপল সরকার (৪৫), যিনি ২০১৮ সালে বিজেপিতে যোগদানের আগে ২০ বছর ধরে সিপিএমের সঙ্গে ছিলেন, বলেন- 'টিএমসিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা সামান্য রাজনৈতিক পার্থক্যের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সিপিএমের ভোট আমাদের জনগণের পঞ্চায়েত গঠনের অনুমতি দিয়েছে।' তাঁর ডেপুটি বিজেপির রীতা হালদার বলেন, 'মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। টিএমসিকে বাইরে রাখার জন্য আমরা সেই রায় মেনে নিয়েছি।'

publive-image
উৎপল সরকার (ডানদিকে), যিনি ২০১৮ সালে বিজেপিতে যোগদানের আগে ২০ বছর ধরে সিপিএমের সঙ্গে ছিলেন। তাঁর ডেপুটি বিজেপির রীতা হালদারের সঙ্গে নদিয়া জেলার চোপড়া ব্লকের কলিঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে। (এক্সপ্রেস ছবি পার্থ পাল)

যাইহোক, রাজ্যস্তরের নেতারা কিন্তু বলেছেন যে তাঁদের নিজের নিজের দলের হাইকমান্ড এই জোটগুলোর জন্য কোনও অনুমোদন দেয়নি। বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, 'এই ধরনের জোট মাঠ পর্যায়ে হয়। দল কখনও টিএমসি বা সিপিএমের সঙ্গে এই ধরনের জোটকে সমর্থন করবে না।' পঞ্চায়েত নির্বাচনের জোটকে, 'অত্যন্ত বিপথগামী ঘটনা' বলে তিনি অভিহিত করেছেন। টিএমসির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেছেন, 'আমরা কখনও এই ধরনের বোঝাপড়াকে স্বীকার করি না।' সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, 'আমাদের অবস্থান পরিষ্কার - বিজেপি বা টিএমসিকে কোনও ভোট নয়। কয়েকটি জায়গায় এসব দলকে সমর্থন করার জন্য আমরা আমাদের মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। অনেক গ্রাম পঞ্চায়েতে, টিএমসি এবং বিজেপি আমাদের পরাজিত করার জন্য জোট গঠন করেছে। তাদের নেতারা কি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন?'

panchayat vote tmc bjp Panchayat poll CPIM panchayat West Bengal panchayat election 2023
Advertisment