আমফান ঝড় বারাসাতের সব তছনছ করে দিয়েছে শুনে সব হাল ছেড়ে দিলেন রাইমা। ৩০ বছরের রাইমা ঘোষের বাড়ি বারাসাতে। মাসের পর মাস ধরে তিনি বিহারের আমনৌর গ্রামে আটকে। রূপান্তরকামী মহিলা রাইমা জানতেন এ পরিস্থিতিতে ষাট বছরের অসুস্থ মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে কোনও ফল হবে না। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিহারের ছাপরার উদ্দেশে যখন রওনা দিয়েছিলেন, তখন তাঁর চোখে জ্বলজ্বল করছিল আশার আলো। লাগান বা লৌন্ডা নাচের এই মরশুম মানেই নগদ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। রাইমার কথায়, “এই টাকায় বাকি বছরটা আরামসে চলে যায়”। বছর সাতেক ধরে লৌন্ডা নাচছেন রাইমা।
লাগান বা লৌন্ডা নাচ বিহার উত্তরপ্রদেশের অভ্যন্তরে এক জনপ্রিয় নাচ। এখানে রূপান্তরকামী মহিলারা বিয়ের আসরে বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই নাচ নেচে থাকেন। লিঙ্গ যৌনতা বিষয়ক ওয়েবজিন বার্তা ট্রাস্টের প্রকাশিত এক আর্টিকেল অনুসারে লাগানের মরশুন বছরে দুবার আসে, যার জেরে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, অন্যান্য রাজ্য, এমনকী নেপালের রূপান্তরকামী মহিলাদের ভরণপোষণ চলে। এই লকডাউনের সময়ে বিহার ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় একশোরও বেশি রূপান্তরকামী মহিলা আটকে পড়েছেন।
উত্তরদিনাজপুরের রূপান্তরকামী অধিকার আন্দোলনের কর্মী জয়িতা মণ্ডলের কথায় এই রূপান্তরকামী মহিলারা বাস্তবিকই অসহায়। তিনি বললেন, “লৌন্ডা নাচের সময়ে বহুল পরিমাণ যৌন হিংসার ঘটনা ঘটে থাকে। বছরের পর বছর ধরে এই ধরনের অনুষ্ঠানে লৌন্ডা নাচিয়েরা বারংবার হিংসার শিকার হয়ে আসছেন।”
কলকাতার রূপান্তরকামী আন্দোলনের কর্মী বিপুল চক্রবর্তী ওরফে বাপ্পা বেশ কয়েক বছর ধরে বিহার উত্তর প্রদেশের এই ধরনের বহু লৌন্ডা নাচের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। বাপ্পার কথায়, “আমরা পুলিশকে নালিশ জানাই না, তার কারণ এই ছোট গ্রামগুলিতে লৌন্ডা নাচিয়েদের মানুষ বলেই মনে করা হয় না। আমরা হলাম আমোদের উৎস। আমরা আর আদৌ মানুষ নেই।”
কিন্তু লকডাউনের জেরে সব বন্ধ থাকায় এখন এরা মালিকের দয়ায় বেঁচে। মালিক মানে যেসব এজেন্টরা তাদের নাচের জন্য বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল। “এই মালিকরা এদের থাকার ও যাওয়া আসার ব্যবস্থা করে। এরাই নাচের বুকিংও নেয়”, বললেন জয়িতা।
২৭ বছরের সাহিল রাজ এরকমই একজন মালিক বা এজেন্ট। তিনি বিহারের আমনৌর গ্রামে আজমেরি মিউজিক্যাল গ্রুপ চালান। ভাল লাগানের মরশুমে তিনি ৬০-৭০টা লৌন্ডা নাচের অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। সাহিল জানালেন, “নাচিয়েদের বাড়ি ফেরত পাঠানোর আগেই লকডাউন হয়ে গেল। এই গ্রামেই আমার মত অনেক এজেন্ট রয়েছে। আমার কাছে পাঁচজন আটকে পড়েছে। অন্যদের কাছে আরও বেশি। আমনৌরেই সব মিলিয়ে ১০০ জনের বেশি আটকে। আমরা ওদের যতটা সম্ভব খাবারের ব্যবস্থা করছি, নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমাদেরও সামর্থ্য সীমিত। প্রতি মাসে পাঁচজন অতিরিক্ত মানুষকে খাওয়ানো তো সহজ নয়।”
২৪ বছরের পূজার বাড়ি উত্তর দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে। গত সাত বছর ধরে তিনি লৌন্ডা নাচের অনুষ্ঠানে যান। এখন তাঁর যে সামান্য সঞ্চয়, তাতেও হাত পড়েছে। “এখানে যা রোজগার করেছিলাম, সব খরচ হয়ে গেছে। এখন যেটুকু জমানো টাকা ছিল, তাই খরচ করছি। আমাদের মালিক আমাদের পাঁচজনের থাকার জন্য একটা ছোট ঘর দিয়েছে। প্রতিদিন কিছু না কিছুর জন্য হাত পাততে লজ্জা করে। আমাদেরও তো আত্মসম্মান আছে।”
শ্রমিক ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন? পূজা জানালেন, “সে জন্য আমাদের জেলার মধ্যে চলাফেরার অনুমতি লাগবে। সবচেয়ে কাছে শ্রমিক ট্রেন ছাড়ছে পাটনা থেকে। এখান থেকে গাড়িতে পাটনা যেতে দু ঘণ্টা লাগে। আমরা কী করে যাব। এটা তো কন্টেনমেন্ট জোন।”
উত্তর দিনাজপুরের রাজ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের ট্রাকে উঠে রওনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে আটকেছেন তাঁর মালিকই। রাজ জানালেন, “আমার মায়ের ক্যান্সার। কেমোথেরাপির একটা তারিখ মিস হয়েছে। আমাকে যে করেই হোক মায়ের কাছে যেতে হবে।” কিন্তু এজেন্টরা বলছেন লৌন্ডা নাচিয়েদের হাইওয়েতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। “আমরা কী করে জানব যে ওরা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছিয়েছে?”
প্রশাসন কী বলছে?
“আমরা বাড়ির বাইরে বেরোলেই পুলিশ গালাগাল দিচ্ছে। আমাদের কথাই শুনতে চাইছে না। এমনকী স্থানীয় নেতারাও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কিছু করতে পারবেন না।”
আমনৌর থানায় ফোন বারবার বেজে গিয়েছে। কেউ ধরেনি।