একটা কচুরি ৫০ পয়সা। ছাত্রছাত্রীরা পাবে অর্ধেক দামে, মানে ২৫ পয়সায়। একটা তেলেভাজা- ১ টাকা। খাস কলকাতায়। গত ২৯ বছরে এই দোকানে এক পয়সাও দাম বাড়েনি খাবারের।
মানিকতলার মুরারিপুকুর এলাকায় কচুরি, তেলেভাজার দোকান চালান মধ্য পঞ্চাশের লক্ষ্মীনারায়ণ ঘোষ। ডাকনাম, মঙ্গল অথবা মংলা।
১৯৯০ সালে মিটার বক্সের একটি পরিত্যক্ত ঘরে তিনি কচুরির দোকান দিয়েছিলেন। তখনকার বাজারমূল্য অনুসারে প্রতিটি কচুরির দাম ছিল ৫০ পয়সা। ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি স্কুল রয়েছে। পড়ুয়ারা অনেকেই ছুটির পর বা টিফিনের সময় ভিড় জমাত দোকানে। তাদের জন্য কচুরির দাম অর্ধেক করে দিয়েছিলেন মঙ্গলবাবু। স্কুলের ইউনিফর্ম পরে এলে কচুরির দাম নেওয়া হত ২৫ পয়সা করে। সন্ধ্যায় অবশ্য কচুরি নয়, মঙ্গলের দোকানে আলুর চপ, মোচার চপ, ধোঁকার চপ, বেগুনি, পেঁয়াজির আয়োজন থাকত। তিন দশক আগের বাজারদর অনুযায়ী মঙ্গল সেসবের দাম নির্ধারণ করেছিলেন ১ টাকা করে।
প্রায় তিন দশক কেটেছে। বাজার দরের হাল সকলেই জানেন, জানেন মঙ্গলাও। কিন্তু সে জানার আঁচ তিনি ফেলতে দেননি তাঁর ২৯ বছরের পুরনো দোকানে। এখনও তাঁর দোকানে ২৫ এবং ৫০ পয়সায় কচুরি পাওয়া যায়। তেলেভাজার দাম এখনও ১ টাকা!
এই দোকান ছাড়া অন্য কোনও উপার্জনের মাধ্যম নেই মঙ্গলবাবুর। এত কম দাম নিয়ে কী করে সংসার চলে? মঙ্গল বলেন, "সমস্যা তো একটু হয় বটেই। কিন্তু যা হোক করে সংসার চালিয়ে নিই। যখন দোকান শুরু করেছিলাম, তখন আলুর কেজি ছিল ৫০ পয়সা, এখন ১৫-২০ টাকা। কিন্তু এতদিন যখন বাড়াইনি, কোনওদিন আর দাম বাড়াব না।" কেন? মঙ্গলের জবাব, "পাড়ার মধ্যে দোকান তো, সবাই এতদিন ধরে খাচ্ছেন। স্কুলের বাচ্চাগুলো ভিড় করে আসে, তৃপ্তি পাই। এতদিন পরে দাম বাড়ালে অনেকে দুঃখ পাবেন। কচুরির সাইজ একটু ছোট করেছি। চপ অবশ্য আগের মতোই আছে। আমার ঠিক চলে যাবে।"
মঙ্গলের দোকান নিয়ে এলাকাবাসীর বিস্ময়ের শেষ নেই। স্থানীয় বাসিন্দা অর্ণব সরকারের কথায়, "এত বছর হয়ে গেল, সবকিছু বদলে গেল, আমরা ছোট থেকে বড় হলাম, কিন্তু মঙ্গলকাকুর কচুরির আর দাম বাড়ল না! আশ্চর্য মানুষ একজন!"
১৯৯০ সালে রাজ্যের মসনদে "গরিব মানুষের সরকার" বামফ্রন্ট। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যুব কংগ্রেস নেত্রী। নরেন্দ্র মোদীর নাম তখনও কেউ শোনেননি প্রায়।
রাজ্যে এখন তৃণমূল সরকার। বামফ্রন্টের অবস্থা মলিন। নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রত্যাশী। গরিব মানুষ ক্রমশ বেহাল হয়েছেন।
লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর দোকানটি রয়ে গেছে গরিব মানুষের মতই, গরিব মানুষের জন্যও। তাঁর লক্ষ্মীমন্ত দোকানটির লক্ষ্মী অচলা।