সময় দিয়েছিলেন ঠিক দুপুর তিনটেয়। বলেছিলেন, ঠাসা কর্মসূচী রয়েছে, দেরি করা যাবে না। সময়ের মিনিট পাঁচেক আগে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখা গেল তিনি বসে রয়েছেন, অনুগামী পরিবৃত। পরনে সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা, বুকে জোড়াফুল ব্যাজ। বন্ধ ঘরে এসি চলছে, রোদের নামগন্ধ নেই, অথচ তাঁর চোখে ঢাউস মাপের হলুদ সানগ্লাস! সানগ্লাস কেন পরেছেন জানতে চাইলেই উত্তর, "কেন, খারাপ লাগছে? এই আমার কালো সানগ্লাসটা আন.." আধ মিনিটের মধ্যে নতুন সানগ্লাস চড়িয়ে বললেন, "এই ইমেজটা ভাল যায়, বুঝলে..."
ইন্টারভিউ অবশ্য সানগ্লাস ছাড়াই দিলেন। ফেসবুক লাইভ থেকে নরেন্দ্র মোদী, মহিলাদের আগ্রহ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পারিবারিক ইতিহাস থেকে তৃণমূলের টিকিট না পাওয়া - অনর্গল কথা বললেন মদন মিত্র, যাঁর দাদু ছিলেন সতীশচন্দ্র মিত্র, কলকাতা পুরসভার প্রথম ভারতীয় চিফ ইঞ্জিনিয়ার, এবং বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বন্ধু।
ফেসবুকে জনপ্রিয়তায় আপনি কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিপক্ষ?
মমতার সঙ্গে আমার একটাই তফাত - মমতার পেজে সবসময়ই প্রশংসা, মানুষের ভালবাসা, আর্শীবাদ থাকে। আর আমার পেজে সবচেয়ে বেশি গালি থাকে। ভারতবর্ষে দু'জনের পেজ সবচেয়ে বেশি গালি খায় - নরেন্দ্র মোদীর পেজ আর আমার।মোদী আমেরিকায় বসে বললেন, উনি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি রোজ আড়াই কেজি গালি খান। অর্থাৎ উনি গালির মাপটা বুঝতে পারলেন, কিন্তু ৩৫০ কেজি বিস্ফোরক যে ঢুকে গেল, সেটা বুঝতে পারলেন না। আনফরচুনেট। আর মমতার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী, মাউন্ট এভারেস্ট। আমি মাউন্ট এভারেস্টের পাদদেশে আছি, এটুকু বলতে পারি। মমতা মেগাস্টার, সুপারস্টার, আমি টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার।
মদনদা, আপনার 'পাঁচ মিনিট পর লাইভে আসছি' তো বিপুল জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে!
ঠিকই, এখন ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে, একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হলে বলে, 'পাঁচ মিনিট পর লাইভে আসছি, ওকে?' কোনও কথা হবে না। তবে আমি বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। ধরুন, আমি একটা আপডেট দিলাম - দু'টোয় লাইভে আসছি। এবার আমি সেই সময় আটকে গেলাম - কোনও মিছিলে বা কর্মসূচিতে ফেঁসে গেলাম। কিন্তু মানুষ তো আমার জন্য অপেক্ষা করছেন! আমি তাঁদের সময় নষ্ট করব কেন? আমি একবার দেখে নিই কতজন পোস্টটা দেখছেন। ধরা যাক, ১০,০০০ লোক পোস্টটা দেখেছেন। তাঁরা তো আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। টাইম ইজ প্রেশাস। আমি আমার দেরিটা নিয়ে তাদের অ্যালার্ট করে দিই। আসলে আমি কী করছি না করছি, তা নিয়ে মানুষের একটা আগ্রহ আছে।
তবে কিনা তার বেশিরভাগটাই নেগেটিভ আগ্রহ। সবসময়ই যেন মদন মিত্র খারাপ কাজ করছে। এটা করছে, ওটা করছে। সেলুলয়েডের চশমা পরছে। দিনের বেলা খোলা চশমায় থাকে, রাতের বেলা সানগ্লাস পরে। কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি তা নিয়ে আপডেটটা দিলে কী হয়, মানুষের ধারণা চেঞ্জ করা না গেলেও তাদের আমার গতিবিধি নিয়ে অবহিত করা যায়। তাছাড়া, আমি ফেসবুকে সব আপডেট দিই মূলত আমার বিধানসভা এলাকার মানুষের জন্য। এই যেমন আমি এখান থেকে বেরিয়ে একটা আপডেট দেব, ডানলপ অফিসে যাচ্ছি। তারপর যাব রথতলা, তারপর ২৩০-এ। সব আপডেট দেব। এতে হবে কী, গোটা বিধানসভা জেনে যাবে আমার গতিবিধি। তুমি যে কোনও ভোটার, আমাদের দলের লোক বা সিপিএম-বিজেপি যাকেই জিজ্ঞেস করবে সে বলে দেবে ওই তো মদন মিত্র ওখানে বসে আছে, আপডেট এসেছে।
লাইভে আদৌ কাজ হয়?
নিশ্চয়! লাইভে কত কাজ হয় একবার বলি। আমাদের একটি ছেলে, ওলা-উবের গাড়ি চালাত, সম্প্রতি দুর্ঘটনায় মারা গেল। আমি পরিবারের সঙ্গে দেখা করলাম। তারপর লাইভ করে সবাইকে গোটা ঘটনাটা বললাম। দশ মিনিট পরে দেখি ৯৭৬ জন ওয়াচিং! যাঁরা ফেসবুক করেন, তাঁরা এর তাৎপর্য বুঝবেন। তাঁরা বুঝবেন, এটা শেষ অবধি কোথায় যাবে! ৪০ হাজার ওলা উবের চালক রয়েছেন, তাঁরা জানলেন। আমি তাঁদের বললাম আপনারা পাঁচ মিনিটের রোজগার দিন৷ ১০ টাকা করেও যদি হয়, তাও অনেকটা।
আপনার প্রতি অনেকে আজেবাজে মন্তব্যও তো করেন।
নর্মালি আমায় মূলত চ্যাংড়া ছেলেমেয়েরাই গালাগালি করে। ওরা একটু ক্রেজি হয় তো! একটা কথা বলি, সবকিছুরই ভাল-খারাপ আছে। কাল যখন ঝড় এসেছিল, আমি একটা তিরিশ তলা বাড়ির ছাদে ছিলাম। অসাধারণ! এত এনজয় করেছি কাল রাতে কী বলব! এই নিয়েও আবার ঝড় উঠবে, কী করছিলেন ছাদে? যাক, তখন আমাকে একজন বলল, আপনি খালি রডটা ধরে রাখবেন, আপনার পাশের টেবিলটা গতকাল ঝড়ে উড়ে গিয়ে গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে পড়ল। তাহলে, ঝড়ের যেমন ভাল আছে, খারাপও আছে। ভগবানকেও তো কত লোক গালাগালি দেয়, আমাকে দেবে না? পৃথিবী একটা বিরাট জায়গা, দু-চারটে জীবজন্তু থাকবেই। কেউ কেউ একটু ক্রেজি আছে, গালাগাল দেয়।
ফেসবুকে আপনাকে ফোন করেন কেউ?
আমার কাছে প্রধানত ফোন আসে সৌদি আরব-সহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে। শারজা, দুবাই, ব্যাঙ্কক, মানে গোটা মিডল ইস্ট থেকেই আসে। প্লাস জেরুজালেম, আমেরিকা, নিউইয়র্ক। লাইভ নিয়েই লোকে জানতে চায়। রেগুলার যোগাযোগ। এবার নর্থ আমেরিকার যে পুজোটা আছে, ১৯৭০ সালে শুরু, তারা কলকাতায় এসে তাদের ৫০ বছর পূর্তিতে আমাকে আমন্ত্রণ করে গেছে একজন বিশেষ সেলিব্রিটি মানুষ হিসেবে। নো মন্ত্রী, নো এমএলএ, নট কিচ্ছু। যাব, ইচ্ছা আছে।
আপনার কথার তো ভুল ব্যাখ্যা হয়.....
হয় তো বটেই। ধর, একটি মেয়ে নাচছে। সেটা ভাল না খারাপ আমি বলব না। তবে নিশ্চয় টিআরপি আছে। নাহলে স্বপ্না চৌধুরির তো এত রেট হত না বা ভোজপুরির মোনালিসা এত ক্রেজি হত না। তা মেয়েটা ভিজে টিজে নাচছে। সে ভিজে নাচা তো সেই রাজ কাপুরের সময় থেকেই আছে। এবার, আমি একদম অন্য জায়গায় হয়তো তোমাকে বলছি, ভাই তোমার লেখাটা অসাধারণ হয়েছে! কিছু লোক করল কী, ওই অসাধারণ শব্দটা কেটে নিয়ে মেয়েটার নাচের পরে জুড়ে দিল! আমি আমার দক্ষিণেশ্বরের বাড়িতে বসে অসাধারণ শব্দটা বলেছি। পিছনে দেওয়াল টেওয়াল আছে, ছবি আছে। আর মেয়েটা নাচছে ওপেন, রাস্তার ধারে। লোকে করল কী, কেটে দুটোকে জুড়ে দিল! এটা এখন কোনও ব্যাপার নয়। তবে এখন ৯০ শতাংশ লোক বুঝে গেছেন, সহজেই এগুলো করা যায়। যেমন এক্ষুণি গণেশের মাথা চাই, তাই হাতির মাথা কেটে বসিয়ে দিল। এখন যে মিমে আর ট্রোলে এমন জোড়া যায়, লোকে বুঝে গেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে আপনি কী করেন?
আমি কাউকে গালাগাল করিনি, সাইবার ক্রাইমে অভিযোগ করিনি। লাইভে এসে বলেছি, আমি দুঃখিত। কেউ যদি আমায় অপছন্দ করেন, করতেই পারেন। কিন্তু আপনি মনে রাখবেন, আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয়। আপনি আমায় অপমান করতে এসে আসলে নিজেই অপমানিত হচ্ছেন। আপনি যে কদর্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছেন, তাতে আপনার ইগো হয়তো পরিতৃপ্ত হচ্ছে, কিন্তু যাঁরা দেখছেন, তাঁদের চোখে আপনার চরিত্র কলুষিত হচ্ছে।
আমায় নিয়ে একটি ট্রোল পেজ তৈরি হয়েছিল। সেই পেজের অ্যাডমিনরা একদিন আমায় ফোন করল। বলল, আমরা ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্র, আপনি যতদিন অ্যাপ্রূ্ভ না করবেন, আর কোনও মিম পোস্ট করব না। আমি জবাবে বললাম, ভাই, আমার কিছু বলার নেই, দুনিয়া জুড়ে এমন চলছে। তবে খারাপ কিছু কোরো না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, কমল হীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে, তার থেকে যে আলোটা ঠিকরে বেরোয় তাকে বলে কালচার। যাঁদের কালচার থাকে, তাঁদের খুব একটা বিদ্যের দরকার পড়ে না। যেমন রবীন্দ্রনাথ, ইউনিভার্সিটি ডিগ্রির দরকার পড়েনি। যেমন, ইন্দিরা গান্ধী।
আসলে নানা ধরনের লোক থাকে তো! যাঁরা লাইক করছেন, তাঁদের কেউ পুলিশ, কেউ ক্রিমিনাল। কেউ প্রেমিক, কেউ ধর্ষক। সবাই একসঙ্গে কী করে আমায় পছন্দ করবেন? আরেকটা কথা বলি, আমি অত্যন্ত সহিষ্ণু। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী সহিষ্ণু নন। আমি এই বিষয়ে মনমোহন সিংহের সঙ্গে সহমত। অসহিষ্ণু মোদি প্রধানমন্ত্রীর পদকে কলঙ্কিত করেছেন। সেই থেকে আমি শিখেছি। রামকৃষ্ণদেব বলতেন তিনটে স। স, স, স! সহ্য কর, সহ্য কর, সহ্য কর। আমিও সহ্য করি।
কিন্তু আপনার দলের সরকার তো অম্বিকেশ মহাপাত্রের রসিকতা সহ্য করেনি! আপনি মুখ্যমন্ত্রী হলে ওঁকে গ্রেফতার করতে বলতেন?
সব কথার সবসময় উত্তর থাকে না। অম্বিকেশ মহাপাত্র এমন একটা সময়ে, এমন একটা পরিস্থিতিতে, এমনভাবে মন্তব্য করে ফেলেছিলেন, আমার মনে হয় না করাটাই ভাল ছিল। আমি সেই মূহুর্তে, সেই জায়গায় থাকলে, অতদিন আগে আমার মানসিক অবস্থা কী রকম হত, সেটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। আমি তো ফিলোজফার নই।
লোকসভা নির্বাচনে টিকিট পেলেন না, মন খারাপ হয়নি?
একদমই কষ্ট হয়নি। প্রার্থী তালিকা যেদিন বেরোল, সেদিনই লোকে আমায় বলল, আরে দাদা, লোকসভা তো বটেই, উলুবেড়িয়া বিধানসভারও লিস্ট বেরিয়েছে - ইদ্রিশ আলি প্রার্থী, তোমার নাম কোথাও নেই! আমি বললাম, আরে লোকসভা, বিধানসভায় তো একজন করে দাঁড়ায়, আমার নাম সব জনসভায় আছে। জনসভায় কত লোক থাকে বল! সবাই যদি লোকসভা, বিধানসভা করে, জনসভাটা করবে কে!
এসব তো কৌশলী উত্তর! মদন মিত্র কৌশলী উত্তর কেন দেবেন?
আসলে কী হয়েছে তোমায় বলি। আমি বাস্তু দেখে পার্টি করি না। কোনটা ঈশান কোণ, কোনটা উত্তর-পূর্ব, বাস্তু কেমন, মাঝখানে পিলার থাকা উচিত নয়, তাও আছে কিনা - এসব দেখি না। এবার কে পকেটে পিলার নিয়ে ঘুরছে, কে উত্তর-পূর্বে কোণে আছে, আমি তো সে সব জানি না। বরাবরই আমার জ্যামিতি আর জিওগ্রাফি একটু খারাপ।
আমার এক বন্ধু, নাম বলছি না, এখন বিরাট পজিশনে আছে। সে আমায় একদিন জিজ্ঞেস করল, তুই যে জামাকাপড় পরিস, কীসের ভিত্তিতে? আমি বললাম, সোমবার সাদা পরি, শিবের দিন। মঙ্গলবার লাল পরি, হনুমান চালিশার দিন, বুধবার শ্রীকৃষ্ণের দিন নীল বা গ্রিন পরি, বৃহস্পতিবার পীত পরি, শুক্রবার সব পরা যায়, হালকা কালার। শনি নীল, রবি হচ্ছে সুন্দর কিছু একটা, তোমার মনের মতো। ও কী করল, সেটা শুনে গোলমাল করে নীলের দিন লাল আর লালের দিন নীল পরে ফেলল। আর খুব ঝাড় খেয়ে গেল। এখন খুব বড় জায়গায় আছে, কিন্তু ঝাড়েও আছে। তারপর থেকে আমি ড্রেস কোড চেঞ্জ করে ফেললাম। যা মনে হয়, পরে ফেলি।
আপনার নাতিও তো আপনার সুবাদে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে।
তা হয়েছে ঠিকই, তবে আমার বাড়িতে বলে দিয়েছে, বিশেষ করে আমার স্ত্রী আর ছেলে-ছেলের বৌ বলেছে, ওর ছবি ছেড়ো না। খুব প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে। আমি শুনলাম, যে স্কুলে ও পড়ে সেখানে এমন কিছু আচরণ করছে, যেমন আচমকা গান গেয়ে ফেলছে..., এখন ওর চার বছর বয়স, আপাতত মনে হয় সুইমিং পুলে রয়েছে... যাক গে, যেটা বলছিলাম, স্কুলে নাকি ম্যাডামরা বলেছেন, ও খুব ইমোশনাল, হঠাৎ হঠাৎ গান গেয়ে ফেলে! স্কুলে তো ওর পরিচয় দেওয়া হয় না, তাও অনেকে জেনে যায়। অন্যান্য ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েরা কেউ কেউ নাকি বলেছে, ও তাহলে তো নিজের ঠাকুর্দার মতোই হয়েছে! ঠাকুর্দাও তো যখন তখন যেখানে সেখানে গান গায়।
খুব দুষ্টু, খুব ইনটেলিজেন্ট, খুব ফাঁকিবাজ। তবে ও রিয়েলি খুব পপুলার হয়ে গেছে। ছোট থেকে বকত, তোমাকে আজ বেরোতে হবে না! আমি বলতাম, না বেরোলে চলবে কী করে? ও বলত, পার্টির লোকদের বাড়িতে ডেকে নাও! বাড়িতেই পার্টি কর। আমি সবাইকে বলছি চা দিতে।
মহিলারাও তো নানারকম কমেন্ট করেন আপনার পোস্টে।
মহিলারা এমন অনেক কিছু করেন যে বিপদে পড়তে হয়। আমার বাড়িতে দুটো বৌ - আমার বৌ আর বৌমা। বৌয়ের থেকে বৌমা ডেঞ্জার! ধর একটা কেউ কমেন্ট করেছে, বৌ তো ফাঁকা বাড়িতে বলবে যে এসব কী যাচ্ছেতাই কথা। বৌমা তো সকলের সামনেই বলবে, এটা কী হচ্ছে তোমার! আমি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেরোতে পারছি না।
আপনার বাড়ির কথা কিছু বলুন।
আমার ঠার্কুদা, বাবু সতীশচন্দ্র মিত্র, তিনিই আমাদের বাড়ির মূল স্থপতি। আমরা খুলনার কাটিপাড়ায় থাকতাম। ১৮৬০ সালে আমার পূর্বপুরুষেরা এপারে চলে আসেন। আমার ঠাকুর্দা বৃত্তি নিয়ে বিলেতে যান। শুনেছি, কোটের তলায় যে জামাটা ছিল সেটা পুরো ছেঁড়া, তাই গরমে কোট পরে ছিলেন। কিন্তু দুটো ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ডিগ্রি নিয়ে ফেরেন। ১৮৭৮ সালে আমাদের ভবানীপুরের বাড়িটা রেজিস্ট্রি হয়। ভবানীপুর মৌজা, পঞ্চান্নগ্রাম। এটা প্রায় গ্রাম তখনও। সেখান থেকে উনি প্রথম ভারতীয় হিসাবে কলকাতা কর্পোরেশনের ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার। আলিপুর ছিল তখন বেঙ্গলের হেডকোয়ার্টার। তখন বড়লাট থাকতেন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে, ছোটলাট থাকতেন রাজভবনে। আমাদের বাড়ি, নীলকুঠি, বর্ধমানের রাজার বাড়ি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি - এসবই ছিল। আলিপুর রোড ছিল শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। আমাদের বাড়ির সবাই মিত্র স্কুলে পড়ত, আমি ছাড়া।
আপনি কোন স্কুল?
আমি একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তাম। কিন্ডারগার্টেন। কয়েকদিন আগে কলকাতা হাইকোর্টে এক নামী জজ আমাকে বললেন, আমরা পাশাপাশি বসতাম, মনে আছে? যাক সে কথা, তারপর আমি বৃত্তি পেয়ে লোকাল একটা স্কুলে ভর্তি হই। ছোটবেলায় তিনবার ডবল প্রোমোশন পেয়েছিলাম। কেজি ওয়ান থেকে কেজি থ্রি, সেখান থেকে আপার নার্সারি, আপার নার্সারি থেকে ক্লাস টু। আমি ক্লাস ওয়ানে যে বই পড়েছিলাম, সেটা বাংলা স্কুলে পড়লাম ক্লাস ফাইভে। তারপর সেন্ট জেভিয়ার্সে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হই, ১৯৭১ সালে। বাড়ির একটা দুর্ঘটনার জন্য কয়েকদিন কলেজ কামাই হয়, যেতে পারি না। তারপর আশুতোষ কলেজে যাই।
আমার বুকের ছাতি ৫৬ থেকে ৬৫ ইঞ্চি হয়ে যায় এটা ভেবে, বাবু সতীশচন্দ্র মিত্র কলকাতা পুরসভার ভারতীয় চিফ ইঞ্জিনিয়র। আমার ঠাকুর্দা। আমার বাবারা পাঁচ ভাই। আমার ঠাকুর্দা যখন চিফ ইঞ্জিনিয়ার, তখন মেয়রের নাম দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। চিফ এক্সিকিউটিভ সুভাষচন্দ্র বসু। আমার ঠাকুর্দা যখন জেঠিমার বিয়ে দিচ্ছেন, তখন প্রধান দুই অতিথি দেশবন্ধু আর সুভাষচন্দ্র। শুনেছি, ৩০০০ টাকা মাইনে পেতেন।
১৯২৬ সালে জর্জ দ্য সিক্সথ কলকাতায় এসেছিলেন। তখন কলকাতাকে অপূর্ব সাজিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। জর্জ দ্য সিক্সথ গেলেন গঙ্গার পাড়ে। বললেন, আমার মনে হচ্ছে লন্ডনে এসেছি! এই কলকাতাকে লন্ডন করা - এই উচ্চারণটা জর্জ দ্য সিক্সথ করেছিলেন, ১৯২৬ সালে। মুগ্ধ হয়ে জানতে চান, এই ব্যবস্থাপনা কে করেছেন? তখন আমার ঠাকুর্দাকে ডাকা হয়। সঙ্গে সঙ্গে উনি ভাইসরয় জেনারেলকে বলেন এখনই ঠাকুর্দাকে রায়বাহাদুর উপাধি দিতে। মার্টিন বার্নের স্যার রাজেন মুখার্জি, আশুতোষ মুখার্জি আর আমার ঠাকুর্দা - প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে আসতেন। মদ্যপান-টান কোনও ব্যাপার ছিল না। খাওয়া - লুচি, কড়াপাকের সন্দেশ এইসব।
মদনদা, আপনি বাঙাল, আবার মোহনবাগানের ঘাঁটি ভবানীপুরের আদি বাসিন্দা। মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল - কার সমর্থক?
আমার বাড়িতে সবার কার্ড মোহনবাগানের। তখন তো আর ইস্টবেঙ্গলের ব্যাপার ছিল না৷ আমার জেঠু সহ সকলের মোহনবাগানের কার্ড ছিল। তবে আমি মহামেডানের সমর্থক। সেই ভাল। তবে মন্ত্রী থাকার সময় সব ক্লাবকেই সাহায্য করেছি। জানেন, আমাদের বাড়িতে তিরিশটা করে পিয়ানো আর বিলিয়ার্ড বোর্ড ছিল। আমরা ওগুলোর উপর বসে লুডো খেলতাম। আমার জেঠু নীতিশ মিত্র ইংলিশম্যান কাগজের স্পোর্টস এডিটর ছিলেন। ভারতে কনট্র্যাক্ট ব্রিজ শুরু করেন। তিনি নানা জায়গায় খেলতে গিয়ে যা সোনা পেতেন, তা থেকেই জেঠিমার গয়না হত। ওঁকে বলা হত ইন্ডিয়ান প্যাটারসন। উনি বলে দিতে পারতেন কার হাতে কী তাস আছে।
শেষ কথাটা বলি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গুণ, উৎকর্ষতা - সবদিক থেকেই আমি পরিবারে নিকৃষ্টতম। দুর্ভাগ্যবশত, মানুষের কাছে আমার নাম সবচেয়ে বেশি পৌঁছেছে।