তিন বছর বয়সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে, পোলিওতে ডান পা হারিয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগণার সুকুমার দাস। অফিস যাওয়ার পথে উত্তরপাড়া স্টেশনে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছিলেন সুমিত সাউ। এরকমই আরো একটি দুর্ঘটনায় ডান পা কাটা পড়ে বাকুড়ার অটো চালক বিজয় দাসের। কিন্তু এদের কারোরই জীবনের দৌড় থমকে যায়নি। বলা ভালো এদের জীবনকে থমকে যেতে দেয়নি কলকাতার এক আজব কারখানা। শুনে প্রথমে অবাক লাগলেও এমনটায় বাস্তবে হয়েছে। হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে। যে কারখানায় মানুষের হারিয়ে যাওয়া হাত, পা নতুন করে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়। কলকাতার মহাবীর সেবা সদন। এখানে বিনামূল্যে প্রতিবন্ধীদের কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করে দেওয়া হয়। আর মহাবীর সেবা সদনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন বালির প্রিয়রঞ্জন সরকার। একজন সমাজকর্মী।
বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণে সারা পৃথিবীর প্রায় অনেক মানুষই অঙ্গহানি সমস্যায় ভুগছে। এই দেশেও তার সংখ্যাও কম নয়। প্রতিদিন জন্মগত ও দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রচুর মানুষের অঙ্গহানি ঘটে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন হারিয়ে ফেলেন। তাঁদের জন্যেই লড়াই করেন প্রিয়রঞ্জন। প্রিয়রঞ্জনের কথায়, "বছর তিনেক আগে বাঁকুড়ায় একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় আমার একজনের সঙ্গে আলাপ হয়। সেই মানুষটির পা ছিল না। তাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্যে করার কথা বললে সেই মানুষটি নাকচ করে বলেন, যদি একটি কৃত্রিম অঙ্গ বানিয়ে দিয়ে সাহায্যে করলে তার ভীষণ উপকার হবে। তখন থেকেই আমার মাথায় ঘুরতে থাকে কথাটা। আমি খোঁজ করা শুরু করি। মহাবীর সেবা সদনের যোগাযোগ করে জানতে পারি তারা এই ধরণের কাজ করেন। তখন থেকেই এদের সাথে কাজ করা শুরু। ভেবে ভালো লাগছে অনেক মানুষ কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে মুল স্রোতে ফেরাতে পেরেছি।"
একবালপুর এলাকার মহাবীর সেবা সদনের ঢুকতেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলেই, প্রথমে করিডর। এখানেই লাইন ধরে বসেন রোগীরা। তার পাশেই ছোট-বড় নানা যন্ত্রে ঠাসা একটি কক্ষ। কানে ভেসে আসে টুং টাং শব্দ। রীতিমতো একটি কারখানা। যে কারখানায় তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম পা, হাত। কক্ষে সবাই হাত,পা বানানোর কাজে ব্যস্ত। বাইরের একটি ঘরে কেউ মাপ নিচ্ছেন, কেউ নক্সা বানাচ্ছেন। কেউ খোলস তৈরি করছেন। কেউ বা ওই খোলসে যন্ত্রাংশ স্থাপন করছেন। আবার কেউ কেউ মানুষের হাঁটুর সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন কারখানায় তৈরি করা কৃত্রিম পা। এই কৃত্রিম পায়ে ভর করে হাঁটছেন একেকজন। হাঁটতে শুরু করতেই তাদের চোখ-মুখে আনন্দ। নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দ।
দুর্ঘটনা অথবা শারীরিক অসুস্থতার ফলে অঙ্গহানি হলে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনের দিশা দেয় কৃত্রিম অঙ্গ। যদিও অনেক সময়েই সেই অঙ্গের দাম বেশি হওয়ায় তা থেকে যায় সাধারণের নাগালের বাইরে। এ রাজ্যে কৃত্রিম হাত বা পায়ের জন্য হাসপাতালের তালিকায় নাম লিখিয়ে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় কাটানোটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল প্রতিবন্ধী মানুষদের। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে এঁদের মধ্যে হাতেগোনা ক’জনের ভাগ্যে যে হাত বা পা জুটত, তা-ও ছিল নিতান্ত সাধারণ মানের। দৃষ্টিগত ভাবে প্রতিবন্ধকতাকে কিছুটা আড়াল করলেও তা দিয়ে তেমন কোনও কাজ করা যেত না। তবে একবালপুরের এই কারখানায় তৈরি নকল হাত,পা গুণগত মানের দিকে অনেক বেশী উন্নত।
প্রিয়রঞ্জন সরকার বলছিলেন, শহরের কিছু মানুষ এই হাসপাতালের কথা জানলেও গ্রামের অনেক মানুষই এরকম কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির হাসপাতালের ব্যাপারে জানেন না। অনেকে এমন আছেন যাদের আর্থিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় গাড়ি ভাড়া দিয়ে কলকাতায় আসার ক্ষমতাও থাকে না। তাঁদের জন্যে একটা ভ্রাম্যমাণ অ্যাম্বুলান্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই অ্যাম্বুলান্স গ্রামে গ্রামে ঘুরে তৎক্ষণাৎ কৃত্রিম অঙ্গ বানিয়ে দেবে প্রতিবন্ধীদের। এতে অসহায় মানুষদের অনেক উপকার হবে। নিজেরা কাজ করে কিছু উপার্জন করতে পারবে।
এই কৃত্রিম হাত পা তৈরির কারখানায় যারা শ্রমিক তারাও কোনও না কোন দুর্ঘটনায় নিজেদের অঙ্গ হারিয়েছেন। এরকম দু'জন ত্রিদীপ্ত দাস এবং রাধেশ্যাম সাউ। কাজ করতে করতে বলছিলেন নিজেদের জীবনের কথা। বাইরে চিকিৎসা করতে এসে রোগীরাও শুনছিলেন তাঁদের জীবন-যুদ্ধের কাহিনী। রাধেশ্যাম বাবুই প্রথমে বলে ওঠেন, "হঠাৎ-ই একদিন উত্তরপাড়া স্টেশনে রেল অ্যাক্সিডেন্টে আমার একটা পা কাটা গেল! সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা চলে যায়।" একদিন দেখা হয়ে যায় কলকাতার একবালপুরের ‘মহাবীর সেবা সদন’- এর স্টোর ইনচার্জ কর্মকর্তা স্বপন আচার্যের সঙ্গে। তিনি রাধেশ্যামকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তাঁদের অফিসে। রাধেশ্যামের জন্য জয়পুরের পা-এর ব্যবস্থা করে দেন। "পা লাগিয়ে আসার পর স্বপনবাবুকে বললাম একটা কাজের জন্য। উনি রাজস্থানের জয়পুরের মহাবীর বিকলাঙ্গ সমিতির ট্রেনিং সেন্টারে এই কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করতে শেখার জন্য পাঠালেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি যেমন, অন্যদেরও আজ সাহায্য করতে পারছি।"
রাধেশ্যাম বাবুর কথা শেষ না হতেই ত্রিদীপ্তবাবু বলেন তাঁর ছোটবেলার কথা। ছোটবেলায় এক পা হারিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। কিন্ত আমার মা-বাবা হাল ছেড়ে দেননি। প্রতিনিয়ত তাঁরা যোগাযোগ করতে থাকেন বিভিন্ন ডাক্তারের সঙ্গে। চলতে থাকে আমার পড়াশোনাও। একদিন যোগাযোগ হল এখানে। মহাবীর সেবা সদনই পায়ের জন্য ‘ক্যালিবারের’ ব্যবস্থা করে দেয়। পরবর্তীতে এখানের চিকিৎসকরাই ত্রিদীপ্তের জন্যে এখানে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।
বাংলার এই কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির কারখানা নতুন করে বেঁচে থাকার পথ দেখাচ্ছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায় এই আজব কারখানা।