রীতিমতো খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। লোকসভার এথিক্স কমিটির কাছে বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে অভিযোগ করেছেন যে তিনি শিল্পপতি গৌতম আদানি ইস্যুতে প্রশ্ন তোলার বিনিময়ে ব্যবসায়ী দর্শন হিরানন্দানির থেকে ঘুষ নিয়েছেন। বিজেপির সঙ্গে মহুয়া মৈত্রের এই লড়াই অবশ্য নতুন না। ২০১৯ সালে লোকসভার সাংসদ হয়েছেন মহুয়া মৈত্র। তারপর থেকেই তাঁর সঙ্গে বিজেপির লড়াই নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে অসংসদীয় ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ পর্যন্ত করেছে। ২০১৯ সালের ২৫ জুন, মহুয়া মৈত্র সংসদে তাঁর প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার পর থেকে এই বিরোধিতার সূত্রপাত। পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের সাংসদ সাবলীল ভঙ্গিমাতেই সংসদে একের পর এক ইস্যুতে সরব হয়েছেন। যোগ্য বিরোধী সাংসদের ভূমিকা পালন করেছেন।
সংসদে সরব মহুয়া
রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাবে বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি সাতটি লক্ষণের কথা জানিয়েছেন। মহুয়া মৈত্রের দাবি, এই লক্ষণগুলোই প্রমাণ যে ভারতে ফ্যাসিবাদ বাড়ছে। তিনি দাবি করেন, এগুলি হল- 'জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকারের প্রতি ঘৃণা, মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি আবেশ, ধর্ম এবং সরকারের অন্তর্নিহিততা, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পকলার প্রতি অবজ্ঞা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় স্বাধীনতার অবক্ষয়।' তৃণমূল সাংসদের এই ভাষণ গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। অনেকে তাঁর মধ্যে বিরোধী দলের একজন স্পষ্টবাদী সদস্যকে দেখেছিলেন যিনি 'উদারপন্থী' জনতার সঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করতে পারেন। যাইহোক, তাঁর প্রথম বক্তৃতার পর থেকে মহুয়া মৈত্র ধারাবাহিকভাবে তাঁর এই বিরোধিতার ভাবমূর্তি বজায় রেখেছেন। যার সূত্র ধরে বিজেপির সঙ্গে তাঁর বিরোধিতা শীঘ্রই সংসদের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে।
নিশিকান্ত দুবের সঙ্গে টানাপোড়েন
২০২১ সালে, তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি বাতিল বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে, দুবেকে মহুয়া মৈত্র 'বিহারী গুন্ডা' বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। টিএমসি সুপ্রিমো এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ট্যাগ করে, ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার সাংসদ দুবে, এক্স (পূর্বতন টুইটার)-এ বলেছিলেন যে মৈত্র এই শব্দগুলো ব্যবহার করে উত্তর ভারতের জনগণকে, বিশেষ করে বিহারিদের গালি দিয়েছেন।
পেগাসাস সফটওয়্যার বিতর্কে, বিজেপির সঙ্গে মহুয়া মৈত্রের এই লড়াই ফের দেখা গিয়েছে। মহুয়া মৈত্র পোস্ট করে জানিয়েছিলেন যে তিনি খুশি কারণ, প্রিভিলেজ কমিটির বিজেপি সদস্যরা বৈঠকে যোগদানের স্বাক্ষর করতে না-চাওয়ায় বৈঠকই হয়নি। পালটা, নিশিকান্ত দুবে সেই সময় জানিয়েছিলেন যে তিনি প্রিভিলেজ কমিটির প্রধান শশী থারুরের বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস আনবেন। কারণ, বৈঠকের সূচি প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
২০২১ সালে, নিশিকান্ত দুবে ও বিজেপি সাংসদ পিপি চৌধুরী তৎকালীন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে মন্তব্য করায় সংবিধানের ১২১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের অভিযোগে মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস দিয়েছিলেন। গগৈ সেই সময় রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য ছিলেন। মৈত্র এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, তাঁকে বিশেষাধিকার ভঙ্গের হুমকি দিয়ে থামিয়ে দেওয়া যাবে না।
আর, এবার যেহেতু এথিক্স কমিটি তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করেছেন, দুবেও উৎসাহ পেয়ে মৈত্রের বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবারও মহুয়া মৈত্রকে কটাক্ষ করে দুবে বলেছেন যে, তিনি (মহুয়া মৈত্র) 'তাঁর বন্ধুদেরকে দামী উপহার দিতে বাধ্য করেছিলেন।' যেখানে, তাঁর নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শাড়ি এবং চপ্পলের মত সাধারণ পোশাক পরার জন্য পরিচিত!
আরও পড়ুন- মহুয়া মৈত্র বিতর্কে চরম কৌশলী তৃণমূল, কী বললেন জোড়াফুলের মুখপাত্র
বিজেপিকে নিশানা
সংসদের বাইরেও মহুয়া মৈত্র বিজেপিকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করে গিয়েছেন। ২০২১ সালে বঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের পরে একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ করে মহুয়া মৈত্র বলেছিলেন, 'বাংলায় আমাদের 'রক-এর ছেলে'রা দেওয়ালে বসে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মহিলাদের ডাকেন, দিদি ও দিদি!। প্রধানমন্ত্রী সেটাই করছেন।' মহুয়া মৈত্রের একথা বলার কারণ, নির্বাচনী প্রচারের সময় একটি ভাষণে নরেন্দ্র মোদী, 'দিদি ও দিদি' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহুয়া মৈত্র বিজেপির বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযোগের তির চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, বিজেপি প্রতিপদে তাঁর কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করছে। পরে তিনি অভিযোগ করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে ভারতের সমালোচনা বেরিয়েছে। আর, ভারত সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থানগুলির একটি হয়ে উঠেছে। স্পিকারের চেয়ারে সেই সময় ছিলেন রমা দেবী। তিনি মহুয়া মৈত্রকে তাকে শান্ত হতে এবং কম রাগ দেখিয়ে কথা বলতে বলেছিলেন।
পালটা সংসদ কক্ষের বাইরে মহুয়া মৈত্র স্পিকারের কাছে অভিযোগ করেন যে, তাঁকে বক্তৃতায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যার ফলে স্পিকার সংসদ সদস্যদের পরের দিন হাউসের বাইরে এবং ভিতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বলেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে, মৈত্র লোকসভায় বিজেপি সাংসদ রমেশ বিধুরির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে সরব হন। যার জেরে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। শাসক দল সেটা নিয়ে সংসদে হইচই করে।
এরপর সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়। যেখানে থারুরের সাথে মহুয়া মৈত্রকে একটি পার্টিতে ওয়াইন এবং সিগার ধরা অবস্থায় দেখা গিয়েছে। তার ভিত্তিতে মহুয়া মৈত্র অভিযোগ করেন যে, এটা বিজেপির 'ট্রোল আর্মি' পার্টির কাজ। তিনি পালটা এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, 'বিজেপির ট্রোল সেনারা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার ব্যক্তিগত ছবি প্রচার করছে দেখে সবচেয়ে মজা পেয়েছি। সাদা ব্লাউজের চেয়ে সবুজ পোশাক আমার ভালো লাগে। বিজেপি বাংলায় প্রতিবারই হেরেছে, কারণ তারা মহিলাদের ওপর এই ধরনের আক্রমণ করে।'