মহালয়ার কাকভোরে নাকি এই মন্দির প্রাঙ্গণে শোনা যায় নুপুরের আওয়াজ। অনেকেই নাকি দেখেছেন মন্দিরের ভিতর অদ্ভুত এক ছায়ার আবির্ভাবও। ভক্তদের বিশ্বাস, তিনিই নাকি দেবী দুর্গা। যুগের পর যুগ ধরে এভাবেই সাধারণ ভক্তদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস দেবী দুর্গা মহালয়ার দিনেই মর্ত্যে আসেন। আদি কংসবণিক সম্প্রদায়ের এই দুর্গা মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। এই সম্প্রদায়ের দুর্গাপুজো আজও হয় নিষ্ঠার সঙ্গে। মালদার ইংরেজবাজারের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্গাবাড়ি মোড়েই রয়েছে আদি কংসবনিক সম্প্রদায়ের প্রাচীন এই দুর্গা মন্দিরটি।
এই পুজোয় দেবী মাতার পুজোর নৈবেদ্যের জোগাড় শুধুমাত্র পুরুষেরাই করেন। এখানে মহিলারা পুজোয় আনন্দ উৎসবেই ব্যস্ত থাকেন। দেবীর নৈবেদ্যের জোগাড় মহিলারা করতে পারেন না। সবশেষে দশমীর দিন মাচা করে দেবী দুর্গাকে ঘাড়ে নিয়ে কংসবণিক সম্প্রদায়ের সদস্যরাই নিয়ে যান মহানন্দা নদীর নিমতলা ঘাটে। সেখানেই নৌকা করে দেবী দুর্গাকে ঘুরিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়।
যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গেই আদি কংসবণিক সম্প্রদায়ের এই দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। কংসবণিক সম্প্রদায়ের মন্দিরে ঢুকলেই দেখা যাবে অন্তত ৩২ রকমের দেব দেবীর ছোট ছোট মূর্তি। আর কয়েকদিন পরেই মহালয়া। তাই এখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা এই আদি কংসবণিক সম্প্রদায়ের দুর্গাপুজোয়।
আদি কংসবণিক দুর্গাবাড়ি।
আদি কংসবণিক সম্প্রদায়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, প্রায় ৩০০ বছর আগের কোনও একদিন ফুলবাড়ি মহানন্দা নদীর নিমতলা ঘাটে এক বৃদ্ধা স্নান করছিলেন। সেই সময়ে গোলাকার পাথরের এক পদ্মচক্র কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তিনি। এরপর ওই বৃদ্ধা নাকি চণ্ডীরূপী দেবী মায়ের স্বপ্নাদেশ পান। পাথরের ওই গোলাকার পদ্মচক্র পুজো করার কয়েক বছর পর ওই বৃদ্ধা প্রয়াত হন। তার আগে তিনি তৎকালীন জমিদার গিরিজানন্দ দাসকে এই কষ্টিপাথরের গোলাকার পদ্মচক্র তুলে দিয়ে যান। জমিদার গিরিজানন্দ দাস নানা কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য কয়েক মাস পুজো করার পর সেই গোলাকার পদ্মচক্রটি তুলে দেন কংসবণিক সম্প্রদায়ের মানুষদের হাতে।
আরও পড়ুন- জৌলুস কমলেও অটুট সাবেকিয়ানা, মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাসটা সত্যিই বেশ রঙিন!
এই পুজোর পিছনের ইতিহাস…
কথিত আছে, ১৯৭১ সালে সেই সময় মালদার দুর্গাবাড়ি এলাকায় অধিকাংশ বণিক সম্প্রদায়ের সদস্যরা বসতি গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে জমিদার ওই সম্প্রদায়ের মানুষজনদের হাতে এই গোলাকার পদ্মচক্রটি তুলে। এরপর ১২৩৫ বঙ্গাব্দে দুর্গাবাড়িতে মণ্ডপ তৈরি করেন আদি কংসবণিক সম্প্রদায়ের লোকজন । শুরু হয় সেই পাথরের পুজো। এরপরই স্বপ্নাদেশে দেবী দুর্গার মূর্তির দেখেই চণ্ডীমন্ত্রে পুজো শুরু হয়। আর আজও সেই পুজো প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন প্রথা মেনেই চলে আসছে।
তৈরি হচ্ছে দুর্গা প্রতিমা।
বর্তমানে বণিক সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০টি পরিবারের বাস রয়েছে এতল্লাটে। যাদের আর্থিক সাহায্যে এই পুজো হয়ে আসছে। এছাড়াও স্থানীয় মানুষজনও আদি কংসবণিক সম্প্রদায়ের দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রেও নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকেন।
আদি কংসবণিক সম্প্রদায়ের কর্মকর্তা নবগোপাল মণ্ডল, জয়ন্ত কুমার দাসরা জানান, এই পুজোকে ঘিরে চার দিন ধরে দুর্গা বাড়ি মোড়ে বিশাল মেলা বসে। মহিলারা নৈবেদ্যর জোগাড়ে অংশ নিতে পারেন না। এক্ষেত্রে যা করার তা পুরুষেরাই করে থাকেন। এটাই প্রাচীন রীতি। একটা সময় এই মন্দিরের মহালয়ার ভোরে দেবীমাতার নুপুরের আওয়াজ শোনা যেত। অনেকেই নাকি দেখেছেন মন্দিরের ভিতরে অদ্ভুত ছায়ার দৃশ্য। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে শিব, পার্বতী, কার্তিক, গণেশ থেকে নানান দেবদেবীর ছোট ছোট মূর্তি।
আরও পড়ুন- পুজোয় নিয়ম করে এবাড়িতে আসতেন নেতাজি, শতাব্দীপ্রাচীন এই দুর্গাপুজো আজও চর্চাবহুল!
ভক্তেরা দশমীর দিন দেবী মাতাকে কাঁধে করে নিমতলির ঘাটে নিয়ে যান বিসর্জনের জন্য। তার আগে নৌকায় ঘোরানো হয় দেবী দুর্গাকে। আজও প্রাচীন প্রথা মেনেই দেবী দুর্গার ভোগ হিসেবে পায়েস, মালপোয়া, পান্তুয়া-সহ হরেক রকমের মিষ্টি দেওয়ার প্রচলনও রয়েছে। আর পুজোর ক'টা দিন ভক্তি ভরে করা মনস্কামনা পূরণ করেন এখানকার দেবী মাতা, এমনই বিশ্বাস ভক্তদের।