দেশজুড়ে হইচই চলছে মোদি সরকারের কৃষি আইন নিয়ে। দিল্লিতে আছড়ে পড়েছে আন্দোলনের ঢেউ। এরইমধ্যে কৃষি বিল বাতিলের দাবিতে আজ চলছে ভারত বনধ। কিন্তু কেমন আছেন এই বাংলার কৃষকরা? কীভাবে দিনাতিপাত করছেন তাঁরা? বনধ নিয়েই বা কী ভাবছেন? তাঁদের হাল-হকিকত জানতে এরাজ্যের শস্যগোলা বর্ধমানে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা। শষ্য ভাণ্ডারের ঘাম ঝরানো কৃষকদের গলায় আর্তনাদের সুর। আনন্দ নয়, বিষাদের সুর গ্রাম-বাংলায়।
গলসির সাঁকো খাঁ পাড়া গ্রামের কৃষক সুকুর মির্জা। বছর পঞ্চান্নর সুকুর মির্জার পেশা চাষাবাদ। মাত্র ৬ বিঘে জমি বছরে দুবার ধান চাষ করে পরিবারকে নিয়ে তিনি কোনওরকমে দিন গুজরান করেন। স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়ের সংসার চালাতে চাষ ছাড়া যখন যা কাজ জোটে তাই করতে হয় সুকুরকে। জীবন প্রতিপালনে নাস্তানাবুদ এই কৃষক। সুকুর বলেন, "কোনও রকমে ডাল-আলু খেয়ে জীবন চলে যায়। মাছ-মাংস খাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ আছে। এবার ওই ৬ বিঘে জমিতে মাত্র ৩০ বস্তা ধান উৎপাদন হয়েছে। শোষক পোকায় সব ধান শেষ করে দিয়েছে। ওষুধ স্প্রে করেও কোনও সুরাহা হয়নি। এবার তো চাষ করে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।"
আয়ের একমাত্র উপায় চাষই? সুকুর মির্জার জবাব, "বছরে যখন যা কাজ পাই তাই করতে হয়। আর ৪টে ছাগল রয়েছে। তাতে কী আর রোজগার হয়।" দিল্লিতে কৃষকদের আন্দোলন। চলছে বনধ ভারত বনধ। কলকাতা থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দূরের গ্রামে দাঁড়িয়ে সুকুর বলেন, "দিল্লির কৃষক আন্দোলনের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এবার এখানেও বনধ হচ্ছে। আমি তো কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পাইনি।"
এবার বোরো ধানের চাষ ভাল হয়েছিল। বিঘে প্রতি ধান মিলেছে কোনও ক্ষেত্রে ১৪-১৫ বস্তা। সর্বোচ্চ ১৮-১৯ বস্তা ধানও পেয়েছে কেউ কেউ। এক বস্তায় ধানের পরিমান ৬০ কেজি। চাষিদের বক্তব্য, এই খরিফ মরসুমে বেশির ভাগ জমিতেই ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। কোনও চাষি বলছেন ৮-১০ বস্তা। কেউ বলছেন ৫-৬ বস্তা। জমি তৈরি করা, ধান বিজ, সার, ওষুধ, ধান কেটে ঘরে তোলা সব মিলিয়ে এক বিঘে জমিতে কম-বেশি ৮-৯ হাজার টাকা খরচ। বস্তা প্রতি সরকারি সহায়ক মূল্য পেলে কিছুটা সুরাহা হতে পারে। আর খোলা বাজারে এই ধানের বিক্রয় মূল্য বস্তা প্রতি সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এবার যা আমন ধানের উৎপাদন হয়েছে তাতে কোনও চাষিই এবার লাভের মুখ দেখেনি বলেই অভিমত গলসি এলাকার চাষিদের। কারও কারও আয়-ব্যয় দুমুখ সমান হয়েছে। দেশের মধ্যে ধান উৎপাদনে গলসির বিশেষ স্থান রয়েছে।
গ্রামের লাল মোরামের ধুলো উড়িয়ে পাকা ধানের বোঝা নিয়ে যাচ্ছে ট্রাক্টর। ওই ট্রাক্টরও ভাড়ার। এই গ্রামের আরেক কৃষক আম্বিয়া মল্লিক মাত্র ২ বিঘে জমিতে ধান চাষ করেছেন। বাড়িতে পাঁচ জনের পেটের জোগান করতে হয় তাঁকে। আম্বিয়া মল্লিকের কথায়, "বাড়ির খাবারের চাল জমি থেকে চলে আসে। এছাড়া ৪টে গরু ও ১৭টি ছাগল রয়েছে। খাব কী! নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেই দম ফাটছে।" একইসঙ্গে বর্ধমান শহরে নৈশপ্রহরীর কাজ করেন বছর আটান্নর আম্বিয়া। এভাবেই চলছে রাজ্যের শস্যগোলা বর্ধমানের কৃষকদের রোজনামচা।
সাঁকো খাঁ পাড়া থেকে নামো জংশনের দূরত্ব মেরেকেটে ৭ কিলোমিটার। গ্রামের রাস্তা পিচের, একেবারে ঝাঁ-চকচকে। রবিবারের পড়ন্ত বিকেলে দেখা হয়ে গেল কার্তিক ঘোষের সঙ্গে। রাস্তার ধারেই জমির ধান ঝাড়াইয়ের কাজ তদারকি করছিলেন ওই বৃদ্ধ। চাষাবাদের কথা জিজ্ঞেস করতেই কার্তিক ঘোষের জবাব, "ঝাড়খণ্ড থেকে শ্রমিক নিয়ে আসতেই খরচ হয়েছে ২০,০০০ টাকা। ট্রেন বন্ধ ছিল তাই বাস ভাড়া করে আনতে হয়েছে। তাছাড়া যে আনার দায়িত্বে ছিলেন তাঁকে আরও ১,৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।" নিজের ও ভাগের জমি নিয়ে ২৮ বিঘে জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন তিনি। কার্তিকবাবু বলেন, "এক বিঘে জমিতে গড়ে ৭ বস্তার বেশি ধান হচ্ছে না। পোকায় শেষ করে দিয়েছে। এক বিঘেতে খরচ ধরুন ৮-৯ হাজার টাকা। সরকার ধান কিনলে কিছুটা বিপদ্মুক্ত হব। আর কী।" দিল্লির আন্দোলনকে শুধু সমর্থন নয়, তিনি চাইছেন এরাজ্যেও কৃষকদের রাস্তায় নেমে আরও আন্দোলন দরকার। এছাড়া কোনও পথ নেই।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে নেমেছে তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস। রয়েছে অন্যরাও। এরা সবাই কৃষকদের 'স্বার্থে' কাজ করেন বলেই দাবি। বিজেপি পাশ করিয়েছে কৃষি বিল, বাকিরা কৃষক আন্দোলন সমর্থন করে ওই বিলের বিরোধিতা করছে। অবশ্য তা নিয়েও বিরোধীরা একে অপরকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না। কিন্তু রাজ্যের শষ্যগোলার কৃষকদের আর্তনাদ কারও কানে যাচ্ছে না। এমনটাই দাবি খোদ কৃষকদের। সোনার ফসলের কারিগরদের আজ নিজেদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর জোগাড়। খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। আমন ধানের গন্ধে কৃষক এখন আর মাতোয়ারা হয় না। তাঁরা মনমরা। রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের সোনার ফসলের কবিতা-গল্প শ্রবণমধুর। এখন তা ছাপার অক্ষরেই শোভিত। বাস্তব কঠিন থেকে কঠিনতর। চাষিদের মাঠে যাওয়ার সেই নেশাও যেন ক্রমশ কমছে ধানের গোলা বর্ধমানে। কৃষকদের কাতর আর্তি- দুই সরকারই নজর দিক চাষাবাদে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন