Advertisment

ফুটপাতের পাঁচালি পর্ব-২: ফুটপাথই ঠিকানা, 'দুগ্গা' গড়ে বাঁচার লড়াই মঙ্গলের

আঁধারেই দক্ষতার বিচ্ছুরণ।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
Mangal Das is fighting to survive idoll on pavements of Calcutta , ফুটপাতের পাঁচালি পর্ব-২: ফুটপাথই ঠিকানা, 'দুগ্গা' গড়ে বাঁচার লড়াই মঙ্গলের

নিজের সৃষ্টি হাতে মঙ্গল। একপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

কবীর সুমনের গানটা মনে আছে! "এ শহরে এসছো তুমি কবে কোন রাজ্য থেকে। তোমাদের দেশে বুঝি সব মানুষই বাঁশি শেখে আমাদের স্কুল-কলেজে শেখে লোকে লেখা-পড়া। প্রাণে গান নাই মিছে তাই – রবীঠাকুর মুর্তি গড়া…" এই শহরে রোজ অনেক মানুষ ভিড় করেন! পেটের তাগিদে দু বেলা দু-মুঠো খাবারের আশায়। কেউ থাকেন অট্টালিকায় কেউ বা ফুটপাতে। এদের প্রত্যকের জীবনের আলাদা আলাদা গল্প আছে। যেমনটা রয়েছে মঙ্গলের। টি বোর্ডের থেকে ফেয়ার্লির দিকে রাস্তায় যেতে ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স বিল্ডিংয়ের ডান দিকের ফুটপাত ধরে এগোলে অনেক মানুষই ঝুপড়ি বানিয়ে রয়েছেন। এখানেই মঙ্গলের বাসস্থান। পুরো নাম মঙ্গল দাস। বয়স ষোল। এই ফুটপাতে বসেই সে মূর্তি গড়ে। কালী থেকে দুর্গা, গোপাল থেকে বিশ্বকর্মা এই অল্প বয়সে সব প্রতিমা সে গড়তে শিখে নিয়েছে নিজের তাগিদে।

Advertisment

আরও পড়ুন- ফুটপাতের পাঁচালি পর্ব-১: এ শহরের ছিন্নমূল মানুষের ঘরই যখন খোলা আকাশ

কলকাতার রাস্তার ফুটপাতে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা কবে কোন জায়গা থেকে এসেছে তাই ভুলে গিয়েছে। বছরের পর বছর খোলা আকাশের নিচেই তাদের বসবাসের ঠিকানা। ঘরহীন এইসব মানুষের অনেকেরই থাকার কোনও আবাস না থাকায় তারা রাত কাটাতে বেছে নেয় এসব স্থানকে। আবার অনেকের ঘর থাকলেও জীবিকার প্রয়োজন কিংবা অন্য কোনও কারণে বাধ্য হন রাস্তাঘাটে এভাবে জীবন কাটাতে।

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মঙ্গলকে রোজ কাজে বের হতে হয়। ফুটপাতেই ঘুমায়। এটাই তার ঘরবাড়ি। এখানেই তার আশ্রয় জোটে। এই আশ্রয়ে সে শুধু একা নয়, আরো বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়েরা আছে যারা এই রাস্তাতেই থাকে তার সাথে। যদিও আর পাঁচ জনের মতন মঙ্গলের জন্ম ফুটপাতে হয়নি। হয়েছিল হাওড়ার বাগনানে। ওখানে বাড়িও রয়েছে। মঙ্গলের বাবা মা কাজের সূত্রে বহু বছর আগে কলকাতায় এসেছিল। তারপর থেকে এখানেই তার ঠিকানা। বছর পাঁচেক আগে মঙ্গলের মা মারা যায়। তারপর থেকে বাবাও তার সমস্ত দায় দায়িত্ব ছেড়ে অন্য জায়গায় পালিয়েছে। বাড়িতে ফিরতে আর ভাল লাগেনা। এখানেই এখন বেশ ভালো।

publive-image

ছোট বয়স থেকে ফোনের মধ্যে মূর্তি তৈরি করার ভিডিও দেখেই শিখেছে প্রতিমা তৈরির কাজ। "আমি যখন ছোট ছিলাম ফোনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মূর্তি তৈরির ভিডিও দেখতাম, তারপর মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে ঠাকুর তৈরি করে ফেললাম। আমার তৈরি করা প্রথম প্রতিমা ছিল কালী ঠাকুর। ওটাকে বানানোর পর পুজোও করেছিলাম। পুজো শেষে গঙ্গায় ভাসানও দিয়েছি। গত দুবছরে অনেক ঠাকুরই বানিয়েছি এই ফুটপাতে বসে। অনেকে আমার বানানো ঠাকুর দেখে কিনতে চাইলে আমি তখন সেগুলো পঞ্চাশ একশ টাকায় বিক্রি করি। এমনিতে আমি এগুলো বিক্রি করার জন্যে তৈরি করিনা। গত বছর একজন আমায় রাস্তায় বসে দুর্গা ঠাকুর বানাতে দেখে কিনতে চেয়েছিল আমি ওটা পাঁচশ টাকায় বিক্রি করেছি। এ বছরও ঠাকুর বানাচ্ছি। নিজেই পুজো করবো। আমার সব পুজোর মন্ত্র জানা আছে। বন্ধুদের সাথে ফুটপাতে খুব আনন্দ হবে।" রাস্তার একধারে বসে প্রতিমার গায়ে মাটির প্রলেপ দিতে গিয়ে মঙ্গলই কথাগুলো বলছিল।

publive-image

পরিসংখ্যান বলছে, কলকাতার ফুটপাতে লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। সদ্যোজাত থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, সকলেই এই তালিকায় রয়েছেন। পুরুষেরা বেশীরভাগ জনমজুর, মহিলারা বহুতল আবাসনে পরিচারিকার কাজ করে অন্নসংস্থান করেন। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে, ফুটপাতের সংসারে ফিরে আসেন তাঁরা। বছরের প্রতিটা দিনই তাঁদের কাছে এক। পুজোর দিনগুলোতে আলাদা করে ওদের কিছু করার থাকে না। পুজো মণ্ডপগুলোতে ওদের প্রবেশাধিকার নেই। ওরা ভেবেছিলো যত বার মায়ের পুজোয় অঞ্জলি দিতে যাবে, তত বারই এ ভাবেই তাড়া খেয়ে পালাতে হয়েছে আজীবন। তবে এ বার আর ওদের কেউ বাধা দেবে না। মঙ্গলের হাতে তৈরি মাতৃমূর্তিই পূজিত হবে, 'ফুটপাথের দুর্গাপুজোয়'।

publive-image

মঙ্গলের মায়ের মৃত্যুর পরে ফুটপাতে থাকা মানুষরাই তার দায় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। রাস্তার উপর চায়ের দোকান সচি দাসের। সচি মঙ্গলকে নিজের নাতির মতন দেখে। পুজোতে নতুন জামা কাপড় থেকে সমস্ত কিছুর দেখভাল এখন তিনিই করেন। সচির কথায়, "মঙ্গল খুব শান্ত ছেলে। মা মারা যাওয়ার আগে থেকেই ও আমার কাছে থাকে। ছোট থেকেই আমি মানুষ করেছি। আমার নিজের নাতির থেকেও বেশি। আমার সামনেই তো সারাদিন থাকে। নিজের মতন করে ঠাকুর তৈরি করে। সব বাচ্চা কাচ্চারা সে ঠাকুরকে পুজো করে। বাচ্চা ছেলে যখন যা মনে আসে বানিয়ে ফেলছে। ওই দেখুন কেউ কেউ আবার মঙ্গলের তৈরি করা ঠাকুরগুলো ফুটপাতের ধারে সাজিয়ে রেখেছে।"

publive-image

ফেয়ার্লি প্লেসের এই ফুটপাতে প্রায় তেরো চোদ্দটি পরিবারের বসবাস। বেশীরভাগ এসেছেন হাওড়া জেলার বাগনান থেকে। গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা এখানেই থাকে সকলে। এক সময় সকলেরই ঘরবাড়ি জমি জমা ছিল। কোনো কারণে তাদের বাড়ি ঘর সবই হারিয়েছেন ঠিকানা হয়েছে খোলা আকাশের নীচে। ঘরবাড়ি হারিয়ে কোথাও যাওয়ার উপায় না পেয়ে কলকাতা শহরের ফুটপাতেই আশ্রয় নিতে হয়েছে। এদের স্বাধীন দেশে ঠিকানাহীন জনগণ বলা যায়। এদের সকলেরই ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সবই রয়েছে। তবে কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই। অফিসপাড়ার ফুটপাথ ধরে সামান্য এগোলে মহাকরণ। তার উলটো ফুটে সাজ্জাদ এবং ফতেমার থাকার জায়গা। এখানে প্ল্যাস্টিকের ঝুপড়িতে তাদের ছোট সংসার। সাজ্জাদ এবং ফতেমা দুজনের জন্মই এক জায়গার ফুটপাতে। তাঁদের দেশের বাড়ি ছেড়ে চল্লিশ বছর আগে এখানে চলে এসেছিল। বড় বাজারে কুলি মজদুরি করতো। সাজ্জাদ ফতেমার এখানেই প্রেম ভালোবাসা করে বিয়ে। সন্তান সন্ততি নিয়ে এখন এখানেই বসবাস। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত দু'জনে পড়াশুনা করেছে। অর্থের অভাবে বেশিদূর এগোতে পারেনি। সাজ্জাদ এখন বড় বাজারে মজদুরি করে। আরে ফতেমা লোকের বাড়িতে পরিচারিকা। সব ধর্মের মানুষ এখানে মিলেমিশে রয়েছে। ইদ হোক কিংবা পুজো সবাই একসাথেই পালন করে।

publive-image

ফতেমা বলেছিলেন,"আমরা যারা ফুটপাতে থাকি আমাদের সবার জীবন অন্ধকারেই থাকে। আমরা এর মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। এখানের অনেক শিশুরাই প্রতিভাবান। কয়লার মধ্যেই হিরে লুকিয়ে থাকে। সঠিক সুযোগ সুবিধার অভাবে ফুটপাতের মানুষরা হারিয়ে যায়। এখানের বেশীরভাগ মানুষের ভোটার কার্ড আছে। ভোটের আগে নেতারা আসেন আমাদের কাছে। অনেক ধরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। ভোট চলে গেলেই সব হাওয়া। মঙ্গলের মতন আরও অনেকে আছে যাদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিলে অনেকদূর যেতে পারতো। কিন্তু ও ফুটপাতে মানুষ ওকে দেখার মতন কেউ নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে পড়াশুনা করে অনেক বড় হোক এটায় আমরা চাই।"

kolkata Durga Puja 2019 kolkata's footpath
Advertisment