প্লেন এবং জাহাজ ছাড়া পুরনো যা কিছু সবই আছে 'ভাঙ্গাচোরা মেলায়'

ভাঙ্গা মেলায় চাকচিক্য নেই তবে জড়িয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাপ্তির আনন্দ।

ভাঙ্গা মেলায় চাকচিক্য নেই তবে জড়িয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাপ্তির আনন্দ।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
mathurapur vanga mela, mathurapur fair ground, shashi ghosh story

মথুরাপুরের ভাঙা মেলা... এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

যদি আপনাকে বলা হয়, কোনও এক শীতের সকালে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে টাইম মেশিনে চেপে চলে যেতে পারেন আপনার শৈশবে! বিশ্বাস হবে না বুঝি! এই অনলাইনের যুগে এসব ঢপবাজি গল্প বিশ্বাস না হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে বলি, শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার লক্ষ্মীকান্তপুর বা নামখানা লোকালে উঠে নেমে পড়ুন মথুরাপুর রোড স্টেশনে। নেমে মিনিট সাতেক হাঁটাপথ। তারপর দক্ষিণ বিষ্ণুপুরের মেলার মাঠ। মেলায় ঢোকার পরেই আপনার মনে হবে ট্রেন নয় টাইম মেশিনে চড়ে চলে এসেছেন পুরনো যুগের কোনও মেলায়।

Advertisment
mathurapur vanga mela, mathurapur fair ground, shashi ghosh story
মথুরাপুর রোড স্টেশনের ভাঙা মেলা- এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ

যার বয়স ২০০ বছরের বেশী কিংবা কম নয়। এখানকার স্থানীয়রা বলেন ভাঙা বা পুরনো মেলা। সেখানে দাদু-ঠাকুরদার মুখে শোনা গল্পের মতো ক্যামেরা, সাদাকালো টিভি, আবলুস বার্ণিস করা কাঠের আসবাব, বই, সংবাদপত্র, ঘড়ি, বাদ্যযন্ত্র, লন্ঠন থেকে বোতাম টেপা ভিডিও গেমস, কী নেই! মেলায় ঘুরতে ঘুরতে মনে হবে, ছোটবেলার দুনিয়াটা এখানে থমকে আছে। মেলায় সকালে ঢুকলে ঘুরতে ঘুরতে বিকেল গড়িয়ে যাবে তবুও যেন মেলা শেষ হবে না। এই মেলায় যা মিলবে সবই পুরনো। 'ওএলএক্স, কুইকার'-এর সৌজন্যে এমনিতেই ইদানিং পুরনো জিনিস কেনা বেচার একটা চল শুরু হয়েছে। এই গ্রামের মানুষ 'ওএলএক্স' বা অনলাইনের জিনিসের প্রতি ওয়াকিবহাল নয়। এই মেলায় সকলের কাছে একমাত্র জায়গা যেখানে সহজে অনেক কমা দামে মূল্যবান জিনিস কিনতে পারে।

mathurapur vanga mela, mathurapur fair ground, shashi ghosh story
মথুরাপুর রোড স্টেশনের ভাঙা মেলা- এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ
Advertisment

মথুরাপুরের দক্ষিণ বিষ্ণুপুর গ্রামে পৌষ সংক্রান্তিতে শুরু হয় এমনই সব পুরনো জিনিসপত্রের মেলা। চলে প্রায় এক মাস ধরে। প্রতিবছর নিয়ম করে জানুয়ারিতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর গ্রামে বসে এই পুরনো জিনিসের মেলা। এখানে দেখা মিলবে— বাতিল আস্ত কম্পিউটার, তার কি-বোর্ড, মনিটর, এমনকি টেবিলও! পুরনো ক্যালকুলেটর, বইপত্র, জামা কাপড়, খাট বিছানা, টেবিল-চেয়ার, ঘড়ি, জুতো, কম্পিউটার, টিভি, পেইন্টিং, ফোন, চার্জার, সাইকেল, ফ্যান, জলের পাম্প, রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোওয়েভ, টোস্টার, সাউন্ডবক্স এমনকি ভ্যাকুয়াম ক্লিনারও! ফেলে দেওয়া তক্তপোশ, বাতিল কার্পেট, শয্যার খাট থেকে বহু ব্যবহারে জীর্ণ বাচ্চাদের কাঠের দোলনাও মজুত এই মেলাতে। আছে হাতলভাঙা প্যারামবুলেটর, সাদাকালো ছোটো মোবাইল, রং চটা স্যুইচবোর্ড, কাঁচে দাগওয়ালা রিচার্জেবল টর্চও। সংগ্রহগুলো খুঁটিয়ে দেখলে প্রশংসা করতেই হয়! গেরস্থালির জিনিসও পাবেন যেমন বইপত্র, ফুলদানি, ধূপদানি, আয়না থেকে বঁটি বা কাঁচি ছুরিও। বোঝাই যায়, বিক্রেতারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে এসব সংগ্রহ করেছেন।

mathurapur vanga mela, mathurapur fair ground, shashi ghosh story
মথুরাপুর রোড স্টেশনের ভাঙা মেলা- এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ

লোকমুখে এই মেলা নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে, নবদ্বীপ থেকে শ্রী চৈতন্য ওড়িশা রওনা দেওয়ার কালে মকর সংক্রান্তির দিনই মথুরাপুরে রাত্রিবাস করেছিলেন। তখন এখান দিয়ে গঙ্গা বইত। আজ গঙ্গা এখানে না থাকলেও রয়ে গিয়েছে ইতিহাস। আবার কেউ বলেন, এককালে গঙ্গাসাগর যাত্রীরা কোনও কারণে এখানে আটকে পড়েছিলেন। তারা সেই গঙ্গাতেই মকর সংক্রান্তির পূণ্যস্নান সারেন। তখন থেকে শুরু হয় মেলা। এখনও দক্ষিণ বিষ্ণুপুর মহাশ্মশানের ওই ঘাটে পূণ্যস্নান সারেন অনেকে। সবাই বলেন, এই মেলা ফুলেফেঁপে উঠেছে গত ২০০ বছর ধরে।

mathurapur vanga mela, mathurapur fair ground, shashi ghosh story
মথুরাপুর রোড স্টেশনের ভাঙা মেলা- এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ

ক্রমে ক্রমে বেড়েছে জনপ্রিয়তা। আড়ে বহরে বিশাল মেলাটি বসে ১০০ একর জায়গা জুড়ে। ১৫ দিন মেলা চালানোর অনুমতি দেয় প্রশাসন। তবে মেলা চলে প্রায় একমাস ধরে। তাই পৌষ সংক্রান্তির পূণ্যদিনে এখানকার মহাশ্মশান সংলগ্ন পবিত্র পুকুরটিতে চলে পুণ্যার্থীদের স্নান পর্ব। সেই উপলক্ষ্যেই এই মেলার আয়োজন। কিন্তু কালচক্রে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ভাঙাচোরা পুরনো জিনিসপত্রের মেলায় পরিণত হয়েছে এই সংক্রান্তির মেলা। ভাঙ্গা মেলার দোকানদার বিজয় দাস, মজা করে বলছিলেন 'এই মেলায় প্লেন আর জাহাজ ছাড়া সবই পাওয়া যায়। আপনারা শহরের বাবুরা মোবাইলে পুরনো জিনিস অর্ডার করে কেনেন, আমরা তেমনই এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকি।'

mathurapur vanga mela, mathurapur fair ground, shashi ghosh story
মথুরাপুর রোড স্টেশনের ভাঙা মেলা- এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ

এলাকার বেশিরভাগ মানুষ গরিব, প্রান্তিক। কিন্তু তাই বলে কি শহরের মানুষের মতো একটু বিলাসিতার শখ জাগতে পারে না? কিন্তু নেই শহরের মানুষের মতো আর্থিক সম্বল। এদের প্রত্যেকের মুশকিল আসান এই ভাঙ্গা মেলা। অল্প টাকায় শখ পূরণ করতে চলে আসেন এই মেলায়। এইসব পুরনো ফেলে দেওয়া জিনিসের ভিড়ে অনেক কিছু দামি জিনিসও থাকে, যার অ্যান্টিক ভ্যালুও চরম। তবে সেসব এই বিক্রেতারা বোঝেন না। কিন্তু বুঝদার লোকেরা এসবের খোঁজে প্রতি বছর চলে আসেন এই মেলায়। ভাঙ্গা মেলায় চাকচিক্য নেই তবে জড়িয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি। যা খুঁজে পাওয়া যায় প্রাপ্তির আনন্দ।

mathurapur vanga mela, mathurapur fair ground, shashi ghosh story
মথুরাপুর রোড স্টেশনের ভাঙা মেলা- এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ