Advertisment

অন্তরাল থেকে অন্তরাত্মায় মওলানা আজাদ

১৯৪২ সালে স্ত্রী বেগম জুলেখার মৃত্যুর পর ১৯৪৭-এ মওলানা এই বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে দিল্লীতে চলে যান। কিন্তু কলকাতা থেকে যায় তাঁর দীর্ঘ লড়াইয়ের নীরব সাক্ষী হয়ে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
একটি লড়াইয়ের ইতিহাস ও স্মৃতি।

একটি লড়াইয়ের ইতিহাস ও স্মৃতি।

কলকাতার বালিগঞ্জের লাভলক প্লেসের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কালো টুপি, হাতে ছড়ি, রোদচশমা পরিহিত সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেস সভাপতি, সামনের বাগানে বসে রয়েছেন জেবি কৃপালনি, ফিটন গাড়ি চেপে ঢুকছেন জওহরলাল নেহেরু। চলছে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক।

Advertisment

না, এটি কোনও সিনেমার সেট নয়, ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক স্মৃতি রোমন্থনের অধ্যায়। যাঁর বাড়ি, ইতিহাসে তাঁর অবদান আমরা কেবল পাঠ্য বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। ১৯৩২ থেকে ১৯৪৭ অবধি এই বাড়িতেই থাকতেন স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদ। কলকাতার বুকেই বহু স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি আজ তার সমস্ত সংগ্রহ নিয়ে অন্তরালেই দিন যাপন করছে। সেই আড়ালেই আজ উঁকিঝুঁকি দেওয়া যাক।

মওলানা আজাদের স্মৃতিবিজরিত বাড়ি মওলানা আজাদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। ছবি: পল্লবী দে

বালিগেঞ্জর মিলিটারি ক্যাম্পের গেটের বিপরীতে গলিটি দিয়ে খানিক এগোতেই ডান হাতে ইতিহাসের নীরব সাক্ষীর দেখা। সেই সময়ের লাভলক প্লেস আজকের ৫, আসরফ মিস্ত্রী লেন। প্রবেশপথের বাগানবিলাস ফুলের মিষ্টি সুবাস নিয়ে বাড়িটির মধ্যে ঢুকতেই মনে হয় ১৯৩২ থেকে চলা নিরন্তর ইতিহাসের পথে পদার্পণ করলাম যেন। হালকা বার্নিসের গন্ধ মাখা সংগ্রহশালাটির প্রতিটি দেওয়াল ইতিহাসের গল্প বলে।

২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ভবন অধিগ্রহণ করে এবং হেরিটেজ কমিটি বাড়িটিকে ঐতিহ্য-ভবন হিসেবে ঘোষনা করে। ২০০৬ সালে রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী নবনির্মিত মওলানা আজাদ মিউজিয়ামের আনুষ্ঠানিক দ্বার-উদঘাটন করেন। তাঁর পরিবার ও অন্যান্য সূত্র থেকে সংগৃহীত মওলানা আজাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছবি দিয়ে সংগ্রহশালার প্রদর্শন কক্ষটি সাজানো। সমগ্র সংগ্রহশালাটি বর্তমানে দেখাশোনা করে 'মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিস'।

বর্তমানে এটিকে সংগ্রহশালা করে গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে এটিকে সংগ্রহশালা করে গড়ে তোলা হয়েছে। ছবি: পল্লবী দে

বিভিন্ন চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৩২ থেকে ১৯৪৭ অবধি সস্ত্রীক এই বাড়িতে থাকতেন তিনি। নিয়মিত নমাজ পড়লেও গোঁড়ামিকে প্রশয় দেন নি কোনোদিনও। ১৯০৫ সালে অনুশীলন সমিতিতে যোগ, বিপ্লবী কার্যকলাপকে বাংলা-বিহারের সীমানা ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া, ১৯১৯ এ খিলাফত আন্দোলন থেকে ১৯২৩ এ কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনের সভাপতি হওয়া এবং পরবর্তীতে ১৯৩৯-৪০ সালে পুনর্নিবাচিত কংগ্রেস সভাপতি হওয়া মানুষটির রাজনৈতিক জীবনের বহু অধ্যায় লেখা হয়েছে খাস কলকাতার বুকেই। ১৯৪২ সালের ৯ এপ্রিল স্ত্রী বেগম জুলেখার মৃত্যুর পর ১৯৪৭ সালে তিনি এই বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে দিল্লীতে চলে যান। কিন্তু কলকাতা থেকে যায় তাঁর দীর্ঘ লড়াইয়ের নীরব সাক্ষী হয়ে।

কলকাতার অন্যতম সংগ্রহশালাগুলির একটি কলকাতার অন্যতম সংগ্রহশালাগুলির একটি। ছবি: পল্লবী দে

বর্তমানে এই সংগ্রহালয়ের কিউরেটর স্বরূপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে ইতিহাস পরিদর্শনে গিয়ে মনে হলো, মওলানা আজাদ এখানেই রয়েছেন, তিনি রয়েছেন তাঁর সম্ভারে। তাঁর ব্যবহৃত চশমা, টুপি, নানারকমের ছাইদান, চিনা গ্রিন টি-র বাক্স, ১৯৯২ সালে পাওয়া মরণোত্তর ভারতরত্ন, তাঁর নামাঙ্কিত চিনামাটির খাবারের পাত্র, উপহার পাওয়া জোব্বা, শৌখিন আসবাবপত্র এবং পরিশেষে তাঁর বিপুল গ্রন্থ সম্ভার তাঁকে মনে করায়, তাঁর ইতিহাস তুলে আনে চোখের সামনে। মূল্যবান এই সব সামগ্রীর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিস এর পক্ষ থেকে। তাঁর বিপুল বইয়ের সম্ভারকে বিশ্বের পাঠকদের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে সাতশোর কাছাকাছি বইকে পিডিএফ ফাইলে পরিণত করে ডিজিট্যাল লাইব্রেরী মিডিয়াতে রাখা হয়েছে।

স্মৃতিটুকু থাক। ছবি: পল্লবী দে স্মৃতিটুকু থাক। ছবি: পল্লবী দে

ছবি তুলে, গল্প করে, ঘুরে দেখে মনে হলো, ইতিহাসকে বন্দি করা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। কলকাতার বুকে থাকা এই ইতিহাস জানতে হলে হাতে একঘন্টা সময় নিয়ে ঘুরে আসা যায় এই সংগ্রহশালাটিতে। সোম থেকে শুক্র, সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছটা অবধি খোলা, কোনো প্রবেশ মূল্য নেই। আসলে যা আছে তাকে সময় দিয়ে, মূল্য দিয়ে মাপা যায় না। এই অন্তরালে যেতে হবে অন্তর থেকেই। বিকেলের গোধূলিমাখা আলোয় ফিরতি পথে থেকে গেলেন মওলানা, থেকে গেল কিছু স্মৃতিমেদুরতা।

kolkata news kolkata
Advertisment