কাগজে-কলমে চালের মজুত ঘাটতি না-থাকলেও স্বাভাবিক নেই চালের জোগান! সেই কারণে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের স্কুলগুলির পড়ুয়াদের মিড ডে মিল পাওয়া কার্যত যেন দুষ্কর হতে বসেছে। এমনও এক একদিন যাচ্ছে, পড়ুয়াদের মুখে মিড ডে মিলের খাবার তুলে দিতে এক স্কুলকে অন্য স্কুল থেকে চাল 'ধার' পর্যন্ত নিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ নিয়ে 'রহস্য' দানা বাধার সঙ্গেই শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভও বাড়ছে। তারই মধ্যে আবার মিড ডে মিলের বিপুল পরিমাণ সরকারি চাল 'হাপিস' করে দেওয়ার 'গুঞ্জনও'’ ছড়িয়ে পড়েছে। আর তা নিয়েই এখন তোলপাড় জামালপুর। এ সব জেনে মিড ডে মিলের 'চাল বাড়ন্ত'র নেপথ্যে থাকা 'রহস্য' উদঘাটনে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দাবি করেছেন বিরোধীরা।
আরও পড়ুন- চন্দ্রযানে তিনের নেপথ্যের তিন কারিগর, নিজের জেলায় ফিরতেই হইহই রব
জামালপুর ব্লকে প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি, শিশু শিক্ষাকেন্দ্র (এসএসকে) এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র (এমএসকে) মিলিয়ে স্কুলের সংখ্যা আড়াইশোর বেশি। একটি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে আবার তালা পড়ে গিয়েছে। এইসব স্কুলগুলি ধরে ব্লকে এখন পড়ুয়ার সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, 'পড়ুয়াদের মিড ডে মিলের জন্যে খাদ্য দফতর প্রতি তিন মাস অন্তর দুই হাজারেরও বেশি কুইন্ট্যাল চাল ব্লকের বিডিওর দায়িত্বভারে পাঠায়। সেই চাল ব্লকের পাঁচরা এলাকায় থাকা ডিলার রুমে চট্টোপাধ্যায়ের গোডাউনে মজুত হয়। বিডিওর সুপারিশ মেনে ডিলার, স্কুলগুলোর চাহিদামত চাল পৌঁছে দিয়ে থাকেন।
স্কুলগুলির প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের বক্তব্য, এমন ব্যবস্থাপনায় সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্ত, পাঁচ-ছয় মাস হল, স্কুলে চাল সরবরাহের সেই স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা লাটে উঠে গিয়েছে। তার কারণে স্কুলে মিড ডে মিল চালাতে গিয়ে এখন তাঁদের মাথায় হাত পড়ে যাচ্ছে। ব্লকের বেরুগ্রাম অঞ্চলের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, 'আমরা চাহিদামত মিড ডে মিলের চাল চেয়েও সময় মত পাচ্ছি না, এটাই বাস্তব সত্য। বাকি আর কী বলব, বললেই তো ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত সমিতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের রোষানলে পড়তে হবে।' বিদ্যালয়ের নাম ও তাঁর নাম প্রকাশ না-করার শর্তে ওই প্রধান শিক্ষক বলেন, 'এমনও দিন গেছে যে স্কুলের পড়ুয়াদের মুখে মিড ডে মিল তুলে দেওয়ার জন্যে অন্য স্কুল থেকে চাল ধার নিতে হয়েছে। পরে চাল আসার পর সেই চাল শোধ দিয়েছি। এমন অবস্থায় আগে কোনও দিন পড়তে হয়নি। এখন যে পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।'
একই শর্তে চকদিঘি পঞ্চায়েত এলাকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, 'মিড ডে মিলের চাল পাওয়ার গোটা ব্যাপারটাতেই হঠাৎ করে ছন্দপতন ঘটে গিয়েছে। এখন বিডিওকে চালের চাহিদার কথা জানালে বিডিও বলছেন, ডিলারকে জানাতে। তার পরেও আগের মত রুটিন মাফিক চাল স্কুলে আসছে না।' একইরকম অভিযোগ জানিয়েছেন, আরও বেশ কয়েকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকা। তাঁদের মধ্যে জ্যোৎশ্রীরাম পঞ্চায়েত এলাকার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিড ডে মিলের চাল যথাযথ ভাবে না-পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে সরাসরি জেলায় চিঠি পাঠিয়েছেন।
এব্যাপারে জামালপুরের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, সময়মত যথাযথ পরিমাণ মিড ডে মিলের চাল না-পাওয়ায় বেশ কয়েকটি স্কুল চিঠি লিখে আমায় জানিয়েছে।' এমনটা হওয়ার জন্য বিডিও সব দোষ চাপিয়েছেন ডিলার রুমা চট্টোপাধ্যায়ের ঘাড়ে। বিডিও এ-ও বলেন, 'এফসিআই গোডাউন থেকে চাল তো তুলেছে ডিলার। সেই চাল যথাযথভাবে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও ডিলারেরই। সেটা না-হওয়ার সব দায় ডিলারের। এর পরেই বিডিওর কাছে জানতে চাওয়া হয়, 'ডিলারের এমন কাজ কারবারের বিষয়ে জেলায় কি রিপোর্ট করেছেন?' উত্তরে বিডিও বলেন, 'চাল স্কুলে না-পৌঁছনো নিয়ে ডিলারের কাছে জবাব চাওয়া হয়েছিল। ডিলার জানিয়েছেন, গাড়ির সমস্যার জন্য তিনি চাল পৌঁছে দিতে পারেননি। পুজোর পর সব স্কুলে চাল পৌঁছে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তাই লিখিত ভাবে জেলায় কিছু জানাইনি, মৌখিক ভাবে সব জানিয়েছি।'
চাল সব স্কুলে যথাযথভাবে সরবরাহ না-হয়ে থাকলে চাল তো ডিলারের গোডাউনে জমা হয়ে থাকার কথা। সেই স্টক রিপোর্ট কী জেলায় জানানো হয়েছিল? এর উত্তরে বিডিও বলেন, 'স্টক রিপোর্ট তো ঠিকই আছে, ডিলার তো চাল ঘাটতির কোনও রিপোর্ট দেয়নি।' তাহলে চাল 'হাপিস' করে দেওয়ার যে 'গুঞ্জন' ছড়িয়েছে, সেটাই কি সঠিক? এই প্রশ্নের উত্তরেও বিডিও নিশানায় রেখেছেন সেই ডিলারকেই। যদিও ডিলার রুমা চট্টোপাধ্যায়ের সাফাই, গাড়ির সমস্যা কিছুদিনের জন্য ছিল। কিন্তু, তাঁর গোডাউনে নাকি বেশ কয়েকশো বস্তা চাল ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। তাই তিনি সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন। আর সব শুনে জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি বলেন, 'গোটা বিষয়টি আমি এনকোয়ারি করে দেখব।'
বিরোধীরা তো বটেই, এমনকী কেন্দ্রও এই রাজ্যের বিরুদ্ধে মিড ডে মিলে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। তা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে নড়েচড়ে বসেছে রাজ্যের মিড ডে মিল বিভাগ। দফতরের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর প্রতিটি জেলার 'স্কুল' ও 'ব্লক'স্তরে চালের 'স্টক' নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে দেন। তারই মধ্যে মিড ডে মিলের চাল নিয়ে জামালপুরের শিক্ষকদের ক্ষোভ প্রকাশ এবং চাল 'হাপিস' করে দেওয়ার 'গুঞ্জন' বিরোধীদের আনা অভিযোগেই যেন সিলমোহর দিয়েছে। এই ব্যাপারে জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি জিতেন ডকাল বলেন, 'মিড ডে মিলের চাল নিয়ে যে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, তা নিয়ে আমরা উচ্চপর্যায়ের তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।'