বাঙালি জাতি এমনিতেই ভোজনরসিক। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে এক পা এগিয়ে থাকে চিরকাল। শেষপাতে মিষ্টিমুখ না হলে খাওয়াটায় তো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সে কারণেই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত সব মিষ্টি। মিষ্টির কথা স্থান পেয়েছে সাহিত্যের পাতাতেও। ভারতীয় উপমহাদেশে মিষ্টিগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ছানার সন্দেশ। বাঙালি বাড়িতে এক সময় বাড়ির মহিলারাই ছাঁচে ফেলে তৈরি করে ফেলতেন একের পর এক সন্দেশ। মিষ্টি তৈরির জন্যে পাওয়া যেত নানান ছাঁচ। কিছু ছাঁচ তৈরি হত পাথর কেটে আর কিছু কাঠ খোদাই করে। সন্দেশের ছাঁচ সম্বন্ধে নতুন প্রজন্মের অনেকে জানে না। বর্তমানে কলকাতার বেশিরভাগ মিষ্টির দোকানে হাতেই তৈরি হয় ডিজাইনার সন্দেশ।
বলে রাখা ভালো মিষ্টির বা সন্দেশের ছাঁচ প্রাচীন বাংলার এক লোকশিল্প। সুস্বাদু মিষ্টান্নকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলাতেই শিল্পীর মুন্সিয়ানা। বর্তমানে হরেক ছাঁচের মিষ্টির দেখা মেলে শুধু মিষ্টির দোকানেই। এককালে বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হত মিষ্টির ছাঁচ। শুধু মিষ্টি নয়, সুদৃশ্য আমসত্ত্বের ছাঁচ, পিঠের ছাঁচ তৈরিতেও বাড়ির মেয়ে, বউরা ছিল সিদ্ধহস্ত। ছাঁচ মূলত তৈরি হয় মাটি, কাঠ বা নরম পাথরের আধারে। মাটিতে হাতের চাপে, কাঠে সুঁই বা সরু চিজেলের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন আকৃতি, কারুকার্য। গোলাকার, ত্রিভুজাকৃতি, অর্ধচন্দ্রাকার, মৎসাকৃতি এইসব কারুকার্যে শৈল্পিক ভাবনা চিন্তা ফুটে ওঠে বাংলার ফুল-ফল, সামাজিক উৎসব ও লোকায়ত ধারণাগুলি। ডিজিটালের যুগে এসবের খবর এখন ক'জনই বা রাখে?
রবীন্দ্র সরণী হয়ে নতুন বাজারের দিকে হেঁটে গেলে দেখা মেলে কিছু কাঠের দোকান। এখানে আজও চোখে পড়ে সেসব কাঠের ছাঁচ। বেতের ডালার উপর ছড়িয়ে রাখা নকশারা। একটা সময় ছিল যখন এখানে একের পর এক ছাঁচ শিল্পীরা এক নাগাড়ে বসে কাজ করে যেতেন। এখন গোটা বাংলাতেই ছাঁচ তৈরির শিল্পী বলতে হাতে গোনা কয়েকজন। কলকাতার বুকে দু'একজন ছাঁচ শিল্পী যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে রুদ্রদেব দাস অন্যতম। গত ৪২ বছর ধরে তৈরি করে যাচ্ছেন সন্দেশের তৈরির কাঠের ছাঁচ। পাথুরিয়াঘাটার ফুটপাথের একধারে সাড়ে চার ফুট বাই দু'ফুট ছোট্ট দোকান। ৭২ বছরের রুদ্রদেব এখানে বসে কাঠের উপর ফুটিয়ে তোলেন একের পর এক নকশা। রুদ্রদেব বাবুর কথায়, 'একটা সময় কাঠের ছাঁচের ব্যাপক চাহিদা ছিল। অনেক খরিদ্দাররাই আসে কিন্তু এক হাতে কতটাই জোগান দেওয়া যাবে? নতুনরা তো কেউ এই কাজে আসছে না। তাছাড়া আগে বিবাহ বার্ষিকী থেকে ভাইফোঁটা উৎসব পার্বণের নানা রকম কাঠের নকশাকাটা মোটিফ কিনতে আসতেন মিষ্টি ব্যবসায়ীরা। এখন সেই তুলনায় ব্যবসায়ীদের আনাগোনা কমেছে। মিষ্টি তো সব এখন হাতেই তৈরি হচ্ছে। নকশা তৈরির শিল্পীরা তো হারিয়েই গিয়েছে।'
কাঠ খোদাই করে নকশা তৈরির ইতিহাস এই বাংলায় অনেক পুরনো। উনিশ শতকের শুরুর দিকে কলকাতার অনেক জায়গাতেই ছিল কাঠ খোদাই করা শিল্পীরা। ছোটো ছোটো ঘুপচি ঘরগুলোতে এক নাগাড়ে কিছু মানুষ কাঠের উপর কাঠ রেখে বাটালি আর হাতুড়ির ঘা মেরেই চলেছে রাত দিন। চারপাশের চলমান জগৎ নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। রুদ্রদেব দাসও ছিলেন তাদের দলে। কালের নিয়মে একে একে সকলে হারিয়ে গিয়েছেন। পড়ে রয়েছেন রুদ্রবাবুই। ট্রাম লাইন ধরে কত মানুষ এলো আর গেলো সেদিকে নজর নেই। বাটালি আর হাতুড়ি ঠুকে কাঠের উপর ফুটিয়ে তুলছেন একের পর এক নকশা। খদ্দেরের ভিড় তেমন নেই, অথচ খদ্দের আছে, সে আসবে সময় হলে। কাঠের উপর উল্টো অক্ষর কাটছে। কাজের মাঝে যেসব খদ্দেররা আসছেন তারা সকলেই জেলার। নতুন নকশা তৈরির বরাত দিতে। রাশিয়া, আমেরিকা থেকে কেউ এলে এখনও তারাও রুদ্রবাবুর হাতের তৈরি কাঠের নকশা কিনে নিয়ে যান। 'অনলাইনে আমার নিজের তৈরি জিনিস বিক্রি হয়। বিদেশ থেকেও লোকজন এসে আমার হাতের তৈরি কাজ নিয়ে যায়। এই কাজকে বাঁচিয়ে রাখার লোকটায় তো নেই, নিজের ছেলেই তো এই কাজে কোনও আগ্রহ দেখায় না। আমি যখন এই কাজে এসেছিলাম তখন আমি অন্যের দোকানে কাঠ খোদাইয়ের কাজ করতাম। ভালবাসার টানে এই পেশায় এসেছি। তারপর নিজের উপার্জনে এই দোকান করেছি। আমার পরবর্তীতে এই দোকানের কি হবে আমার জানা নেই! যতদিন বেঁচে থাকবো মিষ্টি তৈরির নতুন নতুন ছাঁচের নকশা তৈরি করে যাবো।' বলছিলেন রুদ্রদেব বাবু।
অতীতে বাংলার ঘরে ঘরে মা বোনেরা হাতেই বানাতেন নারকেল সন্দেশ, ক্ষীরের বা ছানার সন্দেশ। তাদের হাতের অবসর সময়টা ওনারা ব্যবহার করতেন বিভিন্ন গার্হস্থ্য শিল্পকলায়। এর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল ছাঁচ শিল্পীদের। এখানে তারা ফুটিয়ে তুলতেন, বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাকে। সন্দেশের মাধ্যমেই ফুটে উঠত তৎকালীন সমাজব্যবস্থা। পরবর্তীকালে, এই ছাঁচের ব্যবহার শুরু হয় মিষ্টির দোকানে। বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক ঘটনা, চরিত্র খোদিত হত এই ছাঁচে। বিয়ের অনুষ্ঠানে গোটা মাছের সন্দেশ, গায়ে-হলুদ এবং ফুলশয্যার সন্দেশ তো এখনো ব্যবহার হয়। এছাড়াও জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা সন্দেশ তো আছেই! এরপর এসেছে বিভিন্ন পশু-পাখির ছাঁচ। কালীঘাটের পট চিত্রের আদলে একটা সন্দেশের ছাঁচ। ব্রিটিশ সাহেব সুবোধ, তারাও মুগ্ধ হয়েছিল এই সন্দেশের ডিজাইনে। তাদের খুশি করতে নানা রকম ছাঁচের সন্দেশও সে সময় তৈরি হত।
এখন কাঠের নকশাকাটা শিল্পীরা অবলুপ্তির পথে। যে কয়েকজন রয়েছেন তারা এখনও দু'হাতের জাদুতে তৈরি করে যাচ্ছেন নকশা। রুদ্রদেব বাবু তাদের দলেরই একজন যিনি খোদাই করে রেখে যাচ্ছেন সন্দেশের নকশা।