সকালের রোদ্দুরে রাস্তাঘাটে লোকজন এমনিতেই কম। বেলা বাড়ার সঙ্গে যে কয়েকজন ছিল সেটুকুও কমতে শুরু করেছে। লালবাজারের পাশে ট্রাম লাইন ধরে একটু এগোলেই রাধাবাজার। তার বা পাঁশের ফুটপাথেই এক চিলতে দোকান মহম্মদ দিলজানের। সারিবদ্ধভাবে থাকা বাদ্যযন্ত্রের দোকানের ভিড়ে দিলজানের দোকানটি আলদা করে খুঁজে নিতে একটু অসুবিধেই হবে। তবে দোকানের থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসা কলের গানই জানান দেবে নিজের অবস্থান। তখনই ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষকে এই ছোট্ট চিলতে দোকানের সামনে একবার অন্তত থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে। দোকানের ওপরে সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা মহম্মদ দিলজান গ্রামোফোন মিস্ত্রি। কলকাতা শহরে দিলজানই একমাত্র আছেন যিনি এখনও গ্রামোফোন সারাই করেন।
দোকানের সামনে রাখা ছোট একটি বাক্স। বাক্সের ওপর বড় থালার মতো কালো রঙের রেকর্ড। অনবরত ঘুরে চলেছে, তার ভিতরএই বেজে চলেছে মুঘল-ই-আজম ছবির বিখ্যাত সে গান। ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাওয়া ইতিউতি দু-একজন দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছে যন্ত্রটি। সত্তর বছরের বৃদ্ধের ওসব দিকে খেয়াল নেই। এক মনে ঝুঁকে পরম মমতায় আদরে যন্ত্রটির কলকব্জা নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে নিচ্ছে। যন্ত্রটিকে অনেক বাংলায় বলেন কলের গান। বহুদিন আগে ‘অ্যান্টিক’ তকমা লেগেছে এর নামের আগে। এই অ্যান্টিক জিনিসটিকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছেন দিলজান। ওনার জন্যেই হয়তো কলকাতায় আজও কিছু বাড়িতে গ্রামোফোন যন্ত্রটি সচল রয়েছে। কব্জায় টাইট দিতে দিতেই স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন, "চোদ্দ বছর বয়সে বিহার থেকে চার-পাঁচ মাসের জন্যে কলকাতায় ঘুরতে এসেছিলাম। নিজের গ্রাম মোতিহারিতে তখন কয়েকজনের বাড়িতে গ্রামোফোন দেখেছি। রেকর্ড বাজিয়ে গান শোনার সময় অনেক বাচ্চারা এসে নাচ করতো। এসব দেখে ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। এরপর কলকাতায় এসে দেখালাম সব জায়গায় তখন গ্রামোফোন চলছে। সময়টা ১৯৬৫ সাল। কাজের 'খোঁজ' করতে গিয়ে প্রথম আলাপ নন্দবাবুর সঙ্গে। ওনার কাছেই যন্ত্রটি সারাইয়ের কলাকৌশল শিখে কয়েকবছর পর থেকে শুরু করলাম নিজের এই দোকান। তখন থেকে আজও চলছে।"
স্ত্রী এবং তিন মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে সংসার। পঞ্চাশ বছরের বেশী সময় ধরে গ্রামোফোন সারাই করে পরিবারের জন্যে অন্ন জোগাড় করে চলেছে দিলজান। "ছোট ছেলের দোকানের প্রতি কোন আগ্রহ নেই পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত। আমার পরে আর কেউ নেই যে এই কারবার করবে। আমি শেষ মানে সব শেষ হয়ে গেলো। শ্যামবাজারের এক বাবু আছেন তিনি প্রায় বলেন, দিলজান তুমি চলে গেলে আর কলের গান শোনা হবে না। এখন বাদ্যযন্ত্রের এত দোকান লালবাজারে দেখতে পাচ্ছেন আগে এসব গ্রামোফোন আর রেকর্ডের দোকান ছিল। সময়ের সঙ্গে সবাই গ্রামোফোন ছেড়ে 'মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট' রাখতে শুরু করেছে। আমার দোকানটাই আগের মতন রয়ে গিয়েছে।" হাসতে হাসতে দিলজান এ কথা বলছিলেন নিজের দোকানে বসেই।
১৮৭৮ সালে থমাস এডিসন কাঠের বাক্সের ওপর চোঙা লাগানো এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। যার মধ্যে গোলাকৃতি এক বস্তুর ওপর চাকতির মধ্যে পিন লাগিয়ে ঘোরালে শব্দ উৎপন্ন হয়। যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন 'ফনোগ্রাফ'। বছর দশেক পর জার্মানির বিজ্ঞানী বার্নিলার টিনফয়েল আধুনিক করে মোমের রেকর্ড বানিয়ে নাম দেন গ্রামোফোন। পরবর্তীতে ১৯০০ সালে ভারতে প্রথম নিয়ে আসা হয় গ্রামোফোন। উদ্যোক্তা ছিলেন হেমেন্দ্রমোহন বসু। এরপর ধীরে ধীরে এই শব্দযন্ত্র জায়গা করে ফেলে এলিট ক্লাস মানুষের ঘরে। গান শোনা সকলের এক অভ্যাসে পরিণত হয়। সেই মতন অনেক যুবক আসতে শুরু করে কলের গান সারাইয়ের পেশায়। সত্তরের দশকের পর থেকে বিবর্তনের পালায় গ্রামোফোনের কদর একটু কমতে থাকে। তাও বেশ চলছিল কলের গান। মহম্মদ দিলজানের মতন আরও অনেক কারিগরকে দেখা যেত নিউমার্কেট, চাঁদনী এলাকায়। আস্তে আস্তে সব এই শহরে পেশা বদল করল। পেশা আঁকড়ে ভালোবাসার টানে রয়ে গেলেন এই বৃদ্ধ। এখনও তাই পুরনো নস্ট্যাজিয়ারা ভিড় করে থমকে দাঁড়ায় দিলজানের দোকানের সামনে। ছুটতে থাকা শহরের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বেজে মুঘল-ই-আজম ছবির সেই বিখ্যাত গান 'প্যায়ার কিয়া তো ডারনা ক্যায়া'।