এক-আধ বছরের অপেক্ষা নয়। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে দুই পুলিশ কন্টেবল ছেলের জন্য পথ চেয়ে বসে আছেন দুই মা। একজন কনস্টেবল সাবির মোল্লার সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা মা জাহানারা বেগম। অন্যজন সাবিরের সহকর্মী কাঞ্চন গড়াইয়ের বৃদ্ধা মা মিনতি গড়াই।
২০০৯ সালের ৩০ জুলাই পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড় থেকে অপহৃত হন এই দুই পুলিশ কনস্টেবল। দুই পুলিশ কনস্টেবল ছেলের কেউই সেই থেকে আজও আর বাড়ি ফেরেননি। ছেলেরা আদৌ আর কোনওদিন বাড়ি ফিরবেন কিনা তা দুই মায়ের কারও জানা নেই। তবুও আশা ছাড়তে নারাজ দুই মা । তাই ৩০ জুলাই দিনটা যত বারই ফিরে আসে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না সাবির ও কাঞ্চনের মায়েরা।
বাড়িতে বসে চোখের জল মুছতে মুছতেই রবিবার সাবিরের মা জাহানারা বেগম জানান, ১৪ বছর আগে ৩০ জুলাই, তাঁর পুলিশ কনস্টেবল ছেলে সাবির মোল্লা ও তাঁর সহকর্মী কাঞ্চন গড়াই ধরমপুর পুলিশ ক্যাম্প থেকে লালগড় বাজারে ডিউটি করতে যাচ্ছিলেন। পথেই তাঁরা অপহৃত হন। মাওবাদীরাই সাবির ও কাঞ্চনকে অরহরণ করে পরে খবর আসে। তার পর থেকে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সাবির ও কাঞ্চনের কোনও হদিশ মেলেনি। এবার হয়তো রাজ্য প্রশাসন এই দুই পুলিশ কনস্টেবলকে মৃত বলেই ঘোষণা করে দেবে, এমনই ভাবছেন দুই বৃদ্ধা।
আরও পড়ুন- অধীরকে কুকথায় প্রতিবাদ বৃদ্ধার, গা শিউরে ওঠা রক্তাক্ত পরিণতিতে চোখে জল!
জাহানারা বেগমের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের মেমারি থানার তেলসরা গ্রামে। তাঁর স্বামী ইব্রাহিম মোল্লা ২০০২ সালে মারা গিয়েছেন। পরিবারটি মূলত কৃষিজীবী। জাহানারা বেগমের চার ছেলে ও এক কন্যার মধ্যে সাবিরই সবার ছোট। সাবির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের সশস্ত্র ব্যাটেলিয়নে কস্টবেবল পদে চাকরি পাওয়ায় তাঁদের পরিবারে সুদিন ফেরে। সাবিরের মেজ দাদা সামাদ মোল্লা বলেন , '২০০৬ সালে ব্যারাকপুরে ট্রেনিং সম্পূর্ণ করে আমার ছোট ভাই সাবির মোল্লা। তারপর মাঝে কয়েক বছর সে অন্যত্র ডিউটি করে। ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়ের ধরমপুর ক্যাম্পে পোস্টিং হয় সাবিরের।'
আরও পড়ুন- মারাত্মক মদন! রাজ্যপালকে ভয়ঙ্কর আক্রমণ কামারহাটির তৃণমূল বিধায়কের
ওই একই ক্যাম্পে পোস্টিং হয়েছিল বাঁকুড়ার ছাতনা থানার সুয়ারা বাকড়া গ্রামের বাসিন্দা কাঞ্চন গড়াইয়েরও। কাঞ্চনের বাড়িতে রয়েছেন তাঁর বৃদ্ধ বাবা বাসুদেব গড়াই ও মা মিনতি গড়াই। কাঞ্চনই ছিলেন গড়াই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি।
নিখোঁজ সাবিরের দাদা সামাদ মোল্লা আরও বলেন, '২০০৯ সালের ৩০ জুলাই বিকেলে একই বাইকে চেপে ধরমপুর পুলিশ ক্যাম্প থেকে লালগড় বাজারে ডিউটিতে যাচ্ছিল সাবির ও কাঞ্চন। মাঝপথে মাওবাদীরাই সাবির ও কাঞ্চনকে অপহরন করে কোথায় গুম করে দেয়।' এদিকে, এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর রাজ্য প্রশাসনে তোলপাড় পড়ে যায়। পুলিশের তাবড় মহল নড়েচড়ে বসে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সেই সময়ে ছিলেন রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেত্রী। তিনি অপহৃত দুই পুলিশ কনস্টেবলের পরিবারের পাশে দাঁড়ান। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তদানীন্তন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের কাছেও গিয়েছিলেন। দুই অপহৃত পুলিশ কনস্টেবলের হদিশের জন্য তিনি পি চিদাম্বরমের কাছে স্মারকলিপিও জমা দেন।
আরও পড়ুন- অদম্য চেষ্টায় অভাবনীয় কীর্তি যুবকের! তাক লাগানো শিল্পকলায় মুগ্ধ সকলে!
কিন্তু এতকিছুর পরেও ১৪টা বছর পেরিয়ে গেল। দুই পুলিশ কনস্টেবল সাবির মোল্লা ও কাঞ্চন গড়াই কারও আর হদিশ মেলেনি। সামাদ মোল্লা আক্ষেপের সুরে বলেন, “এবার হয়তো সরকারি নিয়ম মেনেই রাজ্য প্রশাসন অপহৃত হওয়া আমার ভাই কনস্টেবল সাবির মোল্লা ও কনস্টেবল কাঞ্চন গড়াইকে মৃত বলে ঘোষণা করে দেবে।'
আরও পড়ুন- সুপ্রিম নির্দেশ: বেনিয়মের চাকরি গেল হুগলি জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্যার
রাজ্য রাজনীতিতে পালাবদল ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর কিন্তু তিনি দুই অপহৃত পুলিশ কনস্টেবলের পরিবারের কথা ভুলে যাননি। খাতায়-কলমে আজও সাবির মোল্লা ও কাঞ্চন গড়াই “মিসিং অন ডিউটি’ রয়ে আছেন। তবে সাবির মোল্লা ও কাঞ্চনের গড়াইয়ের চাকরির বেতনের টাকা প্রতি মাসে তাঁদের অবিভাবকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। ২০১৭ সালে রাজ্য সরকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টেই সাবিরের এক দাদা সরিফ মোল্লা ও কাঞ্চনের ভাই তারক গড়াইয়ের চাকরির ব্যবস্থা করে ।
তবে অন্য সব সুযোগ সুবিধা এখনও মেলেনি বলে জানিয়েছেন সাবির মোল্লার মা জাহানারা বেগম। বিষয়টি নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিও পাঠিয়েছেন। জাহানারা বেগম বলেন, “বেশ কয়েক বছর ধরে আমার ছেলের বেতনের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রয়েছে। পুরনো বেতনই এখনও পাচ্ছেন। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের বীমার কোনও টাকাই এখনও পাইনি। এমনকী ২০২০ সালের পে-কমিশনের সুবিধাও মিলছে না। মাওবাদী এলাকায় কর্মরত পুলিশকর্মীরা অতিরিক্ত ৩০% বেতন পাবেন বলে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল সেটাও মিলছে না। আগে ডিএ পেলেও এখন সেটাও বন্ধ রয়েছে।' এই বিষয়গুলিই মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে জানিয়েছেন জাহানারা বেগম। একই সমস্য্যার কথা শোনান কাঞ্চন গড়াইরের মাও।
এই বিষয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি তথা রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেস নেতা দেবু টুডু বলেন, “প্রথম থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় অপহৃত দুই পুলিশ কনস্টেবলের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দুই পরিবারের একজনের চাকরির ব্যবস্থাও তিনিই করে দিয়েছেন। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই পরিবারগুলির বিষয়ে ওয়াকিবহাল রয়েছেন।'