ঝাঁ চকচকে শিক্ষাকেন্দ্রে পড়ুয়া আছে, আকাল শুধু শিক্ষকের। শিক্ষকের অপ্রতুলতার জেরে রাজ্যের একাধিক প্রান্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেহাল পরিস্থিতির খবর মাঝেমধ্যেই শিরোনামে আসছে। শিক্ষকের অভাবে এবার পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের একটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে তালা ঝুলেছে।
অন্যদিকে, জেলারই কেলিড়ী ইটখোলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি কোনওমতে একজন মাত্র শিক্ষিকা টিকিয়ে রেখেছেন। যদিও এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পড়াশোনা প্রায় লাটে ওঠারই জোগাড়। পঠন পাঠনে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়ারাও অন্য স্কুলের প্রথম শ্রেণির পড়ুয়াদের চাইতেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে । ছেলে মেয়েরা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে হাজির হয় ঠিকই, মিড-ডে মিল খেয়েই তারা বাড়ির পথ ধরে।
রাজ্যের দিকে দিকে শিশুশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা পাওয়ার পথ প্রশস্ত করে দিতেই ৯০-এর দশকের শেষের দিকে উদ্যোগী হয় শিশু শিক্ষা মিশন-সহ পঞ্চায়েত ও গ্রাম উন্নয়ন দফতর। সেইমতো পরবর্তী তিন-চার বছরের মধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় শিশুশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে সেগুলি সর্বশিক্ষা মিশনের আওতায় রয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের আঝাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কেলিড়ী গ্রামের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রটি সেই রকমই একটি।
আরও পড়ুন- বেড়াল ভেবে ছোট্ট ছানার প্রতিপালন, বড় হতেই তার রূপ দেখে চোখ কপালে!
শুরুতে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের পড়ানোর জন্য নিয়োগ করা হয় চার জন শিক্ষিকাকে। গ্রামবাসীদের আশা ছিল, তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার আলোকে আনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেবে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। শুরুর পর থেকে নাকি সেটাই হচ্ছিল। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের সব আশা ফিকে হতে শুরু করে। তিনজন শিক্ষিকা অবসর নেওয়ার পর আর কোনও শিক্ষিকা নিয়োগ হয়নি এখানে। এখন ৩৬ জন পড়ুয়াকে নিয়ে একমাত্র শিক্ষিকা শুভ্রা ব্যানার্জী শুধুমাত্র কেলিড়ী ইটখোলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রেখেছেন।
কেলিড়ী ইটখোলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে এখন পঠন পাঠন লাটে উঠে গিয়েছে বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। মণিরা খাতুন নামে এক ছাত্রের মা অভিযোগ করে বলেন, 'আমার ছেলে-সহ অন্য ছেলে মেয়েরা প্রতিদিন ব্যাগে বই খাতা নিয়ে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে শুধু খেলাধুলাই করে। মিড-ডে মিল খেয়ে বাড়ি চলে আসে। কী পড়ানো হল জিজ্ঞাসা করলে ছেলে-মেয়েরা রোজই বলে তাদের পড়ানো হয় না। শিক্ষিকাকে বলেও অবস্থার বদল হয়নি।' এরই পাশাপাশি খুদে ছাত্র-ছাত্রীরাও জানায় তাঁদের পড়ানো হয় না।
এলাকারই এক বাসিন্দা শশাঙ্ক ভূমিজ বলেন, “খেতমজুর অধ্যুষিত কেলিড়ী গ্রামে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর থেকে ভাল ভাবেই পড়াশোনা হচ্ছিল। তা দেখে এলাকার সব মা বাবাদের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে এবার হয়তো তাঁদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার আর অসুবিধা হবে না। কিন্তু গত প্রায় চার বছর ধরে কেলিড়ী গ্রামের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে লেখাপড়া লাটে উঠেছে।'
তাঁর কথায়, 'শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি এখন শুধু মিড-ডে মিল খাওয়ার স্কুল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ব্লক প্রশাসন ও স্থানীয় পঞ্চায়েতে সব জানানো হলেও শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পঠন পাঠনের হাল ফেরানোর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যে তিনজন শিক্ষিকা অবসর নিয়েছেন তাঁদের জায়গায় নতুন শিক্ষক শিক্ষিকাও নিয়োগ করা হচ্ছে না।'
আরও পড়ুন- সেলিমের বিতর্কিত সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, আইনি নোটিস পাঠালেন অভিষেকের আইনজীবী
এ বিষয়ে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা শিক্ষিকা শুভ্রা ব্যানার্জীর সাফ জবাব, 'হ্যাঁ,এখানে পড়াশোনার মান অনেক নেমে গেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার একার পক্ষে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র এবং কেন্দ্রের চারটে শ্রেণির ৩৬ জন পড়ুয়ার পড়াশোনার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করা সম্ভব নয়।'
এদিকে কেলিড়ী ইটখোলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্র যখন ধুঁকছে তখন পুরোপুরি কোমায় চলে গিয়েছে জামালপুরের সুচেতা কুমার মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র। বাম আমলে পাড়াতল ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের মুহিন্দর গ্রামে এই শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে ওঠে। মেয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে তোলার জন্য জমি দান করেছিলেন শিক্ষানুরাগী বাবা সুকুমার কুমার।
২০০৭ সালে সুচেতা কুমার মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে পঠন পাঠন শুরু হয়। শুরুর সময় থেকে দু’জন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষিকা সেখানে পড়াতেন। তখন পড়ুয়াদের কোলাহলে মুখর থাকতো এই শিক্ষাকেন্দ্রটি। এখন সবই ইতিহাস। শিক্ষকের আকাল দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়ারাও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া শুরু করে। এখন সুচেতা কুমার মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র শুধু অস্তিত্বের জানানটুকুই দিচ্ছে মাত্র।
বিডিও ( জামালপুর ) শুভঙ্কর মজুমদার বলেন, 'আমরা উদ্ভুত সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ না হলে এর স্থায়ী সমাধান কোনওভাবেই সম্ভব নয়। ব্লকে এই সময়ে ৩১টি এস,এস,কে ও ২টি এম,এস, কে চালু রয়েছে। শিক্ষকের ঘাটতির কারণে ব্লকের একটি এমএসকে বন্ধের প্রপোজাল জেলায় পাঠানো হয়েছে। নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ না হলে চলতি বছরেই ব্লকে আরও ৪-৫ টি এসএসকে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।' এদিকে, সর্বশিক্ষা মিশনের জেলা দফতর থেকেও জানানো হয়, শুধু জামালপুর নয় ,শিক্ষকের ঘাটতির জন্যে গোটা জেলায় অনেক এসএসকে এবং এমএসকে-তে পঠন পাঠন থমকে গিয়েছে।
জামালপুরের প্রাক্তন বাম বিধায়ক সমর হাজরা এ বিষয়ে বলেন, 'শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে এখন জেরবার রাজ্যের শিক্ষা দফতর। দুর্নীতিতে নাম জড়ানোয় প্রায় এক বছর ধরে শ্রীঘরে দিন কাটাচ্ছেন বর্তমান সরকারের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী। রেহাই পাননি শিক্ষা দফতরের কর্তারাও। এ সবের জেরে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে আছে। এরই মাঝে জেল যাত্রাও শুরু হয়ে গিয়েছে। টাকার বিনিময়ে শিক্ষকের চাকরি হাতানোদের জেলে যেতে হচ্ছে। এর ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছে। শিক্ষকের আকালের কারণে কোনও কোনও শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও অস্থায়ী শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে।'