দাবি উঠেছিল বহু আগেই। দেশ স্বাধীন হবার পর দফায় দফায় হয়েছে আন্দোলন, এমনকি অনশন ধর্ণাও। তবু, বহু দশক পেরিয়ে গেলেও মুর্শিদাবাদের পীরতলা হল্ট আজও 'ফ্ল্যাগ স্টেশন' হলো না। অথচ রেলের শর্ত পূরনে কোন ঘটতি রাখেনি পীরতলা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে, ১৯১৪ সালে ট্রেন চলাচল শুরু হয় লালগোলা-শিয়ালদা শাখায়। তখন ভগবানগোলার পরবর্তী স্টেশন ছিল কৃষ্ণপুর। কিন্তু পীরতলা ছিল লালগোলা থানা এবং ভগবানগোলার মধ্যবর্তী অঞ্চল। ফলে যশাইতলা, বালুটুঙ্গি, ফুদকিপাড়া, আইড়মারি, রামচন্দ্রপুর, মানিকচক, ধূলাহুড়ির হাজার হাজার মানুষ প্রয়োজন অনুভব করেন পীরতলাতে একটি স্টেশনের। শুরু হয় গ্রামের সাধারণ মানুষের আন্দোলন।
আরও পড়ুন: খুলে গেছে রামপুরহাট-জসিডি রেলপথ, আবার নাগালের মধ্যে বাঙালীর ঐতিহ্যময় ‘পশ্চিম’
স্থানীয় বাসিন্দা তথা স্টিম ইঞ্জিনের ফায়ারম্যান সওদাগর সরকারের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে দাবি পূরণের আন্দোলন শুরু হয়। তাঁকে গ্রেফতার এবং পরবর্তিতে বদলি করা হয়। আন্দোলনের ব্যাটন তুলে নেন ড্রাইভারপাড়া, ফুদকীপাড়ার মুজিবুর রহমান, আবিদ আলী, উত্তম দাস, কোকিল শেখ, শামসুল শেখ, ইসব নবী, শিবু সান্যাল, অমল কর্মকার প্রমুখ। আন্দোলন চালাতে গিয়ে এঁদের অনেকেই লালবাগ জেলে হাজতবাসও করেন।
ওই সময় বিভিন্ন কায়দায় পীরতলা এলাকায় ট্রেন দাঁড় করানো হত। যাত্রীরা ১০ পয়সার টিকিট কেটে ট্রেনে উঠতেন। সাদা কাগজে রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে লেখা থাকত, 'জনতার স্টেশন-জনতার টিকিট'। সেই টিকিট বৈধ করতে বাধ্য করেছিল তখনকার আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত রেল বোর্ড ১৯৭০ সালের ২২ আগস্ট পীরতলাকে হল্ট স্টেশনের মর্যাদা দেয়।
এই স্টেশন থেকে লালগোলা ব্লকের বৃহত্তর এলাকার মানুষ ছাড়াও ভগবানগোলা ও সাগরদীঘি ব্লকের একটা অংশের মানুষ প্রতিনিয়ত যাতায়াত করেন। স্বাভাবিকভাবেই ওই স্টেশনের যাত্রাপথকে মসৃণ করে তুলতে এলাকার মানুষ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রেল দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছেন। তবে শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করেই বসে থাকেন নি, রেলকে ওই স্টেশন থেকে যথেষ্ট পরিমাণে মুনাফা দিতেও অত্যন্ত আগ্রহী বাসিন্দারা। তাই সকল যাত্রী যাতে টিকিট কেটে যাত্রা করেন, সেই ব্যবস্থা করতে বাসিন্দারাই ১৯৯৩ সালে পীরতলা স্টেশন উন্নয়ন কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির সদস্যবৃন্দ জনতার টিকিট চেকিং এর মাধ্যমে বেশি সংখ্যক যাত্রীকে টিকিট কেটে ট্রেনের যাত্রা করতে বাধ্য করেন।
এর ফলে ২০১৭-১৮ আর্থিক বর্ষে রেলের হিসেব অনুযায়ী দৈনিক ১,৩১৯ জন যাত্রী পীরতলা স্টেশনে বৈধ টিকিট কেটে যাত্রা করেন, এবং রেল ওই স্টেশন থেকে বার্ষিক আয় করেছে ৭৬,১৮,০৬৭ টাকা। রেলের নিয়ম অনুযায়ী, কোনও স্টেশনে দৈনিক ৩০০ যাত্রী এবং ৯ লক্ষ টাকা আয় হলে সেই স্টেশনকে ফ্ল্যাগ স্টেশন করার নিয়ম। রেলের হিসেব অনুযায়ী পীরতলা সেই লক্ষ্য পূরন করে চলেছে ২০০৭-০৮ আর্থিক বছর থেকেই, তা সত্ত্বেও পীরতলা স্টেশনকে ফ্ল্যাগ স্টেশনে রূপান্তরিত করার কোনও পরিকল্পনা করেনি রেল।
যাঁরা এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ জীবিত নেই। কিন্তু মুর্শিদাবাদের পীরতলাকে ফ্ল্যাগ স্টেশনে রূপান্তরিত করার আন্দোলন আজও জীবিত। এ নিয়ে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ সাংসদ তথা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার চিঠি দিয়ে অভিজিৎবাবুকে জানান, পীরতলা স্টেশনের আপ এবং ডাউন প্ল্যাটফর্মের জন্য অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ করে দেওয়ার পাশাপাশি তিনটি শৌচালয়, পাঁচটি প্রস্রাবাগার, এবং চারটি পানীয় জলের ট্যাপ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসবের কিছুই করা হয় নি ওই স্টেশনে।
ইতিমধ্যে আট-দফা দাবি তুলে নতুন করে কর্মসূচি তৈরি করছেন আন্দোলকারীরা। যার মধ্যে অন্যতম হলো, আপ ও ডাউনে বাড়তি চারটি ট্রেনের স্টপেজ, যাত্রীর সংখ্যাধিক্য মেনে ডাউন প্ল্যাটফর্মে টিকিট কাউন্টার নির্মাণ, যাত্রী শেড, শৌচাগার, পানীয় জলের ব্যবস্থা, ট্রেনের আসা যাওয়ার নির্দেশিকার জন্য মাইকে ঘোষণা, ন্যূনতম টেলিফোন সংযোগ, এবং অবশ্যই অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ। এই দাবী না মানা হলে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে নামা হবে বলে জানান পীরতলা স্টেশন উন্নয়ন কমিটির সম্পাদক বীরেন্দ্র নাথ মন্ডল। তাঁর বক্তব্য, "পীরতলা স্টেশন প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলনের কথা কারও অজানা নয়। সেই পথ ধরেই আমরা আমাদের দাবী পূরনের পথে এগাচ্ছি। আর কোন প্রতিশ্রুতিতে আমাদের থামানো যাবে না।"
বাকি আন্দোলনকারীদের মধ্যে আবিদ আলী, ইসব নবী, শামসুল শেখ ইত্যাদি বলেন, "আমরা কয়েক দশক ধরে দাবি পূরণের জন্য আন্দোলন করে আসছি, এখনও দাবী পূরণ হয়নি। ফলে আন্দোলন কোনভাবেই থেমে থাকবে না।"