Advertisment

Premium: 'তারার ছায়া'য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম

অনন্য কীর্তি, মধ্যবিত্তের ইতিহাসকে ধরে রাখার প্রয়াস।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
museum apurbo panda naktala kokata, 'তারার ছায়া'য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম

নিজের গড়া সংগ্রহশালায় অপূর্ব পান্ডা। ছবি- শশী ঘোষ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাদুঘরটি রয়েছে আমাদের দেশেই। সকলের প্রিয় শহর কলকাতাতে। কলকাতা মিউজিয়াম যে শুধু বিশ্বের বৃহত্তম জাদুঘর তা নয়, এটি বিশ্বের প্রাচীনতম জাদুঘরও বটে। এখানে ঘুরতে যায়নি এমন মানুষ হয়তো হাতেগোনা কয়েকজনই আছেন। ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাদুঘরটি। আপনাদের বলে রাখা ভালো বিশ্বের প্রাচীনতম জাদুঘরের শহরে রয়েছে আরও এক অভিনব জাদুঘর। সাধারণ ব্যবহৃত সামগ্রী দিয়েই তৈরি করা এই সংগ্রহশালা। যার প্রতিষ্ঠাতা অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মচারী। নাম অপূর্বকুমার পান্ডা। সংগ্রহশালাটিতে রয়েছে শুধুই ইতিহাসবস্তুর সমাহার। অবিভক্ত বাংলার মধ্যবিত্ত জীবনের ফেলে-আসা, ভুলে যাওয়া জিনিস যা তিনি সংগ্রহ করেছেন তিলে তিলে। আমরা প্রচলিত যে ধরণের জাদুঘর দেখে থাকি তার থেকে একদম ভিন্ন অপূর্বের সংগ্রহশালা।

Advertisment

অপূর্বকুমারের তিনতলা বাড়িতে ঢুকলেই যেন মনে হবে আদ্যিকালের কোন সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছি। সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়্যাটসআপের বহুযুগ আগে যখন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া শেষে মা-কাকিমারা গোল হয়ে বসতেন। বিনোদন বলতে ছিল লুডো কিংবা কড়ি। তাঁদের মধ্যমণি হয়ে থাকত বাহারি পানপাত্র আর সুপারি কাটার জাঁতি। সবই যেন একই রকমভাবে রাখা রয়েছে। শুধু মানুষগুলোই নেই। মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যেসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ছিল যা কালের নিয়মে অকেজো হয়েছে। তা সংগ্রহ করাই অপূর্বকুমার পান্ডার নেশা। অপূর্ববাবুর কথায়, "বই সংগ্রহের নেশা ছিল ছোট থেকেই, একদিন তার ছেলেকে আগেকার দিনের পালকি, গ্রামোফোন, ইঙ্ক ব্লটার বা ডিপ পেন কী, বোঝাতে গিয়ে ছবি দেখাতে বা আঁকতে হচ্ছিল। তখনই চিন্তা করেন পরের প্রজন্মকে এসব জিনিসের সঙ্গে পরিচয় করানোর উচিত। তা না হলে এসবের কেমন দেখতে ছিল তা কেউ কোনদিন চাক্ষুষ অনুভব করতে পারবে না। এভাবেই পেয়ে বসে সংগ্রহের নেশা"

publive-image
অপূর্ব পান্ডার সংগ্রহশালা।

সে সময় সিগারেট রাখা থাকত টিনের কৌটোতে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা তৈরি হতো। শৌখিন যাঁরা, তাঁরা পরতেন সরু ফ্রেমের গোল চশমা। তখন দুধ আসত বোতলে। সেই বোতল মোটা কাচের। তরল সিঁদুরের আমদানি তখনও হয়নি। গুঁড়ো সিঁদুর রাখার কৌটো ছিল কারুকাজ করা। সেগুলি ক্রমশ বাতিল হয়েছে। ব্যবহারিক প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর কেউ কেউ এসব ফেলে দিয়েছেন। কেউ ভরে দিয়েছেন ট্রাঙ্কে। সেই ট্রাঙ্কে এখন জং। খুঁজলেও মেলে না এককালের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গীগুলোকে। কিন্তু এই ছোট ছোট সামগ্রীগুলো মধ্যবিত্ত বাঙালির অভ্যাসের ইতিহাস খোদাই করে রেখে গিয়েছে। সে ইতিহাসই নিজের কাছে সযত্নে আগলে রাখছেন অপূর্বকুমার পান্ডা।

publive-image
পুরনোদিনের স্মৃতি আঁকড়ে অপূর্ব।

মিউজিয়ামটি নাকতলায় নিউ সোনালি পার্ক এলাকায় অপূর্ববাবুর বাড়ি 'ইতিকথা'। সেই বাড়িতেই তৈরি হয়েছে তিনতলাজোড়া সংগ্রহশালাটি। পুরো সংগ্রহশালাটির নাম রেখেছেন 'তারার ছায়ায়'। গান্ধীর ছবি আঁকা সিঁদুরকৌটো, নারকেল কুরুনি, গয়নার বাক্স, আমসত্ত্বের ছাঁচ, কাঠের দোয়াতদান, দুধ-বদনা, পেতলের পানের বাটা, গরুর গলার কেঠো ঘণ্টা, ক্ষুর শানানোর কাচের হোন, গোলোকধাম খেলার ছক, টি-শেপের চামড়ার ফুটবল-সহ অগণিত সংগ্রহ।

publive-image
শতা্ব্দী প্রাচীন গাড়ির মডেল হাতে অপূর্ব পান্ডা।

অনেক সংগ্রাহকই অপূর্ববাবুকে স্মৃতির ফেরিওয়ালা বলেন। আর অপূর্ব যদিও এসব মানতে নারাজ। তিনি নিজে বলেন, 'হাজার বছরের পুরনো দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক সামগ্রী তুলে ধরার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। বাঙালি মধ্যবিত্তের স্মৃতি ধরে রাখার তাগিতে তৈরি করেছি এই মিউজিয়াম।' পুরনো জিনিস সংগ্রহ করার নেশা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। প্রথমে বিখ্যাত ব্যক্তিদের অটোগ্রাফ, বিখ্যাত দম্পতিদের ছবি সংগ্রহ করতেন। গত ২৫ বছর ধরে একটু একটু করে এইসব বস্তু জোগাড় করে চলেছেন অপূর্ববাবু। 'বাবার নাম তারাপদ আর দিদির নাম ছায়া। সেখান থেকেই সংগ্রহশালার নাম রেখেছি'-বলছিলেন অপুর্ববাবু। তিনি প্রথমদিকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে সংগ্রহ শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে ফেরিওয়ালাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জিনিস কেনা শুরু। একইসঙ্গে বিভিন্ন মেলা ঘুরে ঘুরেও সংগ্রহ করেন।

ছেলেকে নিজের ছোটবেলার গল্প করতে গিয়ে দেখলেন, সেকালের কিছুই আর কাছে নেই। ছেলেকে দেখাবেন কী? এই ইচ্ছে থেকে ২০১০ সালে একটি ছোট ফ্ল্যাটে সংগ্রহশালা শুরু করেছিলেন। তারপর নাকতলায় জমি কিনে তৈরি হলো পূর্ণাঙ্গ একটি সংগ্রহশালা। ওই বাড়ির ছোট্ট একটি অংশে পরিবার নিয়ে থাকেন অপূর্ব। সেই বাড়ির একতলায় রয়েছে লাইব্রেরি। সেখানে প্রায় ১০ হাজার পুরনো ম্যাগাজিন রয়েছে। একতলাতেই আলোচনার জন্য সভাঘর ও আড্ডার জন্য জায়গা রেখেছেন। সংগ্রহশালায় আছে ১৫০টির মতো বিভাগ। যেখানে পুরনো দিনের ক্যামেরা, খেলনা, খেলার সরঞ্জাম, লন্ঠন, আলো, রেডিও, টেলিফোন, বিজ্ঞাপন সহ আরও অনেক কিছু রয়েছে। সংগ্রহশালা দেখতে যেতে হলে টিকিট লাগবে না। অপূর্ববাবু বলেন এই সংগ্রহশালা চাইলেই কিন্তু দেখা যাবে না, সঠিক মানুষের রেফারেন্স কিংবা আগাম অনুমতি না থাকলে তার সংগ্রহশালায় কারও প্রবেশের অধিকার নেই।

kolkata news West Bengal Museum
Advertisment