ফরিদ, ইসলাম, তানিল, হারান, গুলশন, বাবু, রসুল, বিজয়, সেন্টু, শান্তি, শক্তিপদ, এই সব নামের মানুষগুলো হঠাৎ হারিয়ে গেলেন পাইকপাড়া গ্রাম থেকে। এ গ্রামে 'অপদেবতার কুদৃষ্টি' পড়েছে, এমন ফরমান দিয়েছিলেন যে 'জানগুরু' অথবা গ্রামে-গঞ্জে ধর্মীয় প্রধান বা বৈদ্য, তিনিও গত হয়েছেন। মড়ক লাগা গ্রাম বীরভূম ঝাড়খন্ড সীমান্তের রামপুরহাট থানার অন্তর্গত পাইকপাড়া।
গ্রামে গরীব দিনমজুরই সংখ্যায় বেশি, আর ঘরে ঘরে ঢুকেছে রোগ। রোগীরা বলছেন, হঠাৎ শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে, তারপর গোটা শরীরে যন্ত্রনা, তলপেটে ব্যথা, নিস্তেজ হয়ে পড়ছে পাথর ভাঙা পরিশ্রম করা জোয়ান ছেলে। গ্রামের এক কোণায় খেদামারা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখান থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা পাঠান রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজে, সেখানে কয়েক হাজার টাকার পরীক্ষার পর তাঁদের বলা হয়, এ কিডনির রোগ তাই এখানে চিকিৎসক নেই, তাই পাঠানো হয় সিউড়ি সদর হাসপাতালে। সেখানেও আশা মেলে না, তাই শয্যাশায়ী রোগীকে নিয়ে বর্ধমানে চারবার গাড়ি বদলে কিডনি বিশেষজ্ঞর কাছে যাওয়া, ওষুধ ইঞ্জেকশন নিয়ে গড়ে প্রতি মাসে ১২,০০০ টাকা খরচ। বাড়ির সব সম্পদ, গবাদি পশু, জমি, শেষ সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসা চলে কয়েকমাস, তারপর ডায়ালিসিসের পালা যখন আসে, ভয়ে ঘরবন্দী হয়ে নীরবে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে পাইকপাড়া।
গ্রামের জনসংখ্যা কমবেশি এক হাজার, ইতিমধ্যে গ্রামে এই রহস্যময় অসুখে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে শতাধিক গ্রামবাসীর। এই মূহুর্তে আক্রান্ত হয়ে গ্রামে আছেন ৬৩ জন, অনেকে অসুস্থ হয়ে গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে কোথায় গেছেন কেউ জানেন না।
দীপঙ্কর সর্দারের বয়স ৩০-এর কোঠায়, বর্ধমানের নেফ্রোলজিস্ট বা কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, দীপঙ্করের কিডনি অচল হয়ে গিয়েছে। একদফা চিকিৎসার পর স্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটেন। স্ত্রী কণিকা সর্দার বলেন, তাঁর যা সোনার গহনা ছিল, তাই বন্ধক রেখে চিকিৎসা করছেন।
গ্রামের মাণিক শেখ বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে তাঁর স্ত্রীর কিডনির অসুখে মৃত্যু হয়েছিল। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকায় কলকাতার সেসময়ের অন্যতম সেরা বেসরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা করিয়েও স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেন নি, তারপর কয়েক বছর বন্ধ ছিল এই রোগে মৃত্যু। কিন্তু সম্প্রতি আবার শুরু হয়েছে মৃত্যু মিছিল। মারিয়া বিবি নামে এক দুঃস্থ মহিলা বলেন, চিকিৎসক তাঁকে জল ফুটিয়ে খেতে বলেছেন, গ্রামে অনেকেই জল ফুটিয়ে খেয়ে সাময়িক স্বস্তি পাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন। কয়েকটি সম্পন্ন পরিবার বাড়িতে জলের ফিল্টারও বসিয়েছেন।
তাহলে কি পানীয় জলের সংক্রমন থেকে কিডনির রোগ ছড়াচ্ছে? পাইকপাড়া লাগোয়া যেসব গ্রাম, সেখানে কিন্তু এধরনের কোন অসুখের খবর নেই। তাহলে শুধু পাইকপাড়ায় কেন? গ্রামের সবাই টিউবওয়েল থেকে পানীয় জল তোলেন, এদিকে গ্রামের চারদিকে পাথরের খাদান। গ্রামবাসীদের অনুমান, খাদানে বিস্ফোরনের কাজে ব্যবহৃত ডিনামাইটের বিষক্রিয়া পানীয় জল স্তরে মিশে এমন হচ্ছে। তবে তাঁদের আক্ষেপ, সরকারী স্তরে বহুবার জানিয়েও কোন লাভ হয় নি।
শেষে সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী আশীষ ব্যানার্জীকে বিষয়টি জানালে তিনি স্বীকার করেন, তাঁর এলাকায় এতবড় সমস্যার কথা তিনি জানতেন না। জানার পর তিনি গ্রামে যান, এবং নিজে কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে গ্রামের পানীয় জল পরীক্ষা করানোর এবং মেডিক্যাল টিম পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
যাদের রোজের হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে গড় আয় ২০০ টাকা, সেসব মানুষদের কাছে মাসে ১২,০০০ টাকার ওষুধ খেয়ে বাঁচাটা বড় পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় আপাতত নীরবে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন অসহায় গ্রামবাসীরা।