রাবিক ভট্টাচার্য, অত্রি মিত্র, জয়প্রকাশ দাস
জমি আন্দোলনকে ভিত্তি করেই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন যে, সরকার জোর করে জমি নেবে না। রাজ্যপাটে ক্ষমতাসীন হয়েই কৃষক দরদী প্রমাণে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে তৃণমূল। সরকারের এক বছর গড়াতেই রাজ্যব্যাপী কৃষক বাজার বা কিষাণ মাণ্ডি তৈরির ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য দাম পান ও ফড়ে-রাজ কমে, সেই লক্ষ্যেই মান্ডি তৈরির সিদ্ধান্ত বলে জানানো হয়েছিল। গত দশ বছরে ১০৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ১৮৬টি কিষাণ মাণ্ডি তৈরি হয়েছে। এক একটি মান্ডির আয়তন গড়ে প্রায় ৩ একর। যার প্রত্যেকটিতেই কৃষকদের জন্য বিশ্রামাগার, গোডাউন, ওয়ে ব্রিজ, সহায়তা কেন্দ্র, পার্কিং এবং অন্যান্য সুবিধা রয়েছে।
দশ বছর অতিক্রান্ত। কী অবস্থায় রয়েছে বাংলার কিষাণ মান্ডিমান্ডিগুলি? তার অনুসন্ধান করতেই দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধিরা হাওড়া, হুগলি ও পূর্ব বর্ধমানের ছয়টি কিষাণ মান্ডিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। বাংলার এই তিন জেলাতেই সিংহভাগ শস্যের ফলন হয়। এই তিন জেলার শুধু কৃষক বাজারগুলিতেই নয়, স্থানীয় বাজারেরও হালহকিকতেরও নজরদারি করা হয়েছে।
বছরে মাত্র দু'বার, রাজ্য সরকার এই মান্ডিগুলি থেকে কৃষকদের ধান সংগ্রহ করে থাকে। তখনই মান্ডিগুলি প্রাণবন্ত হয়। আর বাকি সময়? মাণ্ডিগুলি তখন নানা কাজের ক্ষেত্র। যেমন সেগুলিতে চলে স্থানীয় বিধায়কের দফতর, মাটি সরবরাহের সিন্ডিকেটের অফিস, গাড়ি মেরামতের দোকান, জামাকাপড়ের স্টল, দন্ত চিকিৎসকের চেম্বার ইত্যাদি। অবাক করা বিষয় যে, মান্ডিতে ঘুরলে চোখে পড়বে, কৃষি পণ্য ওজনের মরচে ধরা সব যন্ত্রের। ভেঙে পড়েছে কলঘর।
কেন এই দূরাবস্থা? বহু কৃষক ও ডিলারের অভিযোগ, অধিকাংশ কিষাণ মান্ডির অবস্থান নির্ণয় নাকি ভূল জায়গায় হয়েছে। প্রধানত কৃষি-বিপণন বিভাগই প্রকল্প রূপায়নের মূল দায়িত্বে। যে লক্ষ্যে কিষাণ মান্ডিগুলি গড়ে তোলা হয়েছিল তার সফল বাস্তবায়ণ হচ্ছে না। বিষয়টি আজানা নয় খোদ মুখ্যমন্ত্রীরও। গত ৩রা ফেব্রুয়ারি, একটি প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষক বাজারগুলির সমস্যাসমুহ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে, 'মান্ডিগুলি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।' কৃষি-বিপণন দফতরের মন্ত্রী বিপ্লব মিত্র দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, 'এটা সত্য যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মান্ডিগুলির জন্য জায়গা চিহ্নিতকরণ ঠিক হয়নি। কিন্তু, এই প্রতিটি মণ্ডিই প্রচুর জমি নিয়ে তৈরি ও প্রভূত অর্থ খরচ হয়েছে। তাই আমরা এগুলিকে কার্যকর করার চেষ্টা করছি।'
পূর্ব বর্ধমানের কৃষক বাজারের অবস্থা-
রায়না ব্লকের কৃষক বাজারে দোতলা নীল-সাদা ভবনের একতলায় গায়ে লেখা রয়েছে তৃণমূলের রায়নার বিধায়ক শম্পা ধারার 'জনসেবা কার্যালয়'। কংক্রিটের প্ল্যাটফর্ম জনশূন্য, তবে টিএমসি বিধায়কের অফিসের মতো একটি চায়ের দোকান, কিছু অটোমোবাইল মেরামতের দোকান, গ্যারেজ, গহনার দোকান এবং দাঁতের চিকিৎসকের চেম্বার একেবারে জমজমাট। মান্ডিতে স্টল বিলি নিয়ে দফতরের আধিকারিকের বক্তব্য, 'যেখানে চাহিদা নেই বিলি হয়নি। এগ্রিকালচার রিলেটেড দোকান ফার্স্ট প্রাইরোটি। সেগুলির চাহিদা মেটার পর অন্যদের দেওয়া যেতে পারে।'
অটোমোবাইল মেরামত দোকানের মালিক মাইদুল হক মালিক(৪০) বলেন, 'কমপ্লেক্সে ২২টি দোকান রয়েছে। আমরা প্রতি বর্গফুট মাসিক ৩ টাকা ভাড়া দিই, ১০০০ টাকা অগ্রিম দিয়েছি। তবে আমার কাছে এসবের কোনও কাগজপত্র নেই৷' তাঁর বক্তব্য, 'মান্ডি চালু হওয়ার পর থেকে বিধায়কের অফিস দেখেছি। আমরা তাঁকে ও তাঁর অনুগামীদের এখানে দেখেছি। কিন্তু কৃষক বা পাইকারি কারবারিদের এখানে দেখিনি।'
রায়না থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে জামালপুরের পাঁচরার কৃষক বাজারে গোডাউন, নিলাম এলাকা, ওয়ে ব্রিজ, টয়লেট সবই রয়েছে। ই-রিক্সার খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান, ই-রিক্সা ও পাম্প মেরামত, হার্ডওয়্যার গোডাউন, ডেকরেটার্সের জিনিসপত্র রাখার গোডাউন রয়েছে। ই-রিক্সার মালিকও বলেছেন, '১০০০ টাকা অগ্রিম দিতে হয়েছে। তাছাড়া দোকানের ভাড়া প্রতি স্কোয়ার ফিট ৩ টাকা।'
এই মান্ডিতে কোভিড টিকাকরণ শিবির চলেছে। স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তারা জানিয়েছেন, কোভিডের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় এই কৃষক বাজার কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
পূর্ব বর্ধামান জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা রায়নার বিধায়ক শম্পা ধাড়া বলেন, 'সেখানে জনসেবা কার্যালয় করেছিলাম। এখন অন্যত্র সরে এসেছি। নামটা লেখা আছে। জেলার প্রত্যেকটা কৃষক মান্ডিতে বছরে দুবার কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় হয়। সেখানেই ৮ মাস কেটে যায়। কৃষক মান্ডি বন্ধ আছে এমন নয়।' জামালপুরে বাজার কেন বসছে না সে ব্যাপারে খোঁজ নেবেন বলে জানিয়েছেন সভাধিপতি।
জামালপুর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সলিমডাঙ্গায় সবজির বাজারে দুপুর দেড়টায় গিয়ে দেখা গেল চরম ব্যস্ততা চলছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়ে দেন, তাঁদের কাছে সরকারি কৃষক বাজার সম্পর্কে কিছু জানা নেই। এই বাজার থেকে কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগণা এবং হাওড়া সহ নানা জায়গায় আলু-সহ অন্যান্য সবজি সরবরাহ করা হয়।
বছর চুয়াল্লিশের কৃষক শেখ মুকুল বলেন, 'এই বাজার সপ্তাহে প্রতিদিন খোলা থাকে। কয়েক বছর ধরে আমরা এখানে ব্যবসা করে আসছি। রাজ্য জুড়ে ব্যবসায়ীরা এবং স্থানীয় কৃষকরা এখানেই আসেন। আমরা কৃষক বাজারে কেন যাব?' কৃষক বাজার আছে কী নেই তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই মুকুলের। কৃষক জীবন ঘোষের ভয় কৃষকবাজারে চেকের মাধ্যমে লেনদেন করতে হবে। নগদ লেনদেনেই তিনি স্বচ্ছন্দ। ২৮ বছরের যুবক জীবন বলেন, 'কৃষকবাজারে গেলে আমাদের যাতায়াত খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এই পুরনো বাজারেই রোজদিন ভাল বেচা-কেনা হয়।'
কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা বলেন, 'জামালপুরে সবজির বাজার শিফট করা হয়েছিল। পরে সেই বাজার চলে গিয়েছে।' চেষ্টা করেও কিন্তু এখনও আনা যায়নি। কৃষক বাজার না বসা নিয়ে ওই কর্তার ব্যাখ্যা, 'ওখানে ভেস্টেড ইন্টারেস্ট থাকতে পারে, রাজনৈতিক ব্যাপার তো থাকেই।'
হুগলির কৃষক বাজারের অবস্থা-
আদিসপ্তগ্রাম কৃষক বাজার গিয়ে দেখা গেল নির্জন ভুতুরে বাড়ি। চারিদিক ধুধু করছে। তারই মধ্যে এক দেওয়ালে পাশাপাশি মাত্র দুটি দোকান খোলা। একটিতে সোফা সহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস, অন্যটিতে একদল যুবক ক্যারাম খেলছে। বাইরে ট্রাক, ট্রাক্টর পার্ক করা আছে।
পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক যুবক জানান, ট্রাক ও ট্রাক্টরগুলি তাঁরা ভাড়া খাটান। ওই যুবক জানিয়ে দেন, 'এখানে কখনও মান্ডি হিসাবে ব্যবহার হয়নি। গোডাউনগুলিও খালি, কখনও ভোটের সময় প্রশাসন এখানে ইভিএম রাখে।' স্থানীয়দের বক্তব্য, 'ওই ট্রাক ও ট্রাক্টরে মাটি সরবারহের সিন্ডিকেট চলে। সবাই এসব জানলেও কেউ বলবে না।'
আদিসপ্তগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রাক্তন কৃষি বিপণন মন্ত্রী তপন দাশগুপ্ত বলেন, 'না না এখন কিছু নেই। আমি সব সাফ করে দিয়েছি। ২০২১ সালের আগে করেছিল। পুলিশ দিয়ে সব বন্ধ করে দিয়েছি।' তিনি বলেন. 'ওখানে কলার বাজার বসেছিল। বিক্রি হত না। সামনের মাসে ৭-৮ তারিখ থেকে কলার বাজার আবার বসবে। যোগাযোগের সমস্যা রয়েছে।'
কৃষক মান্ডির জায়গা নির্ণয়ে ভুল হয়েছিল বলে স্বীকার করে নিয়েছেন হুগলি জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ মনোজ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, 'জেলার ১৮টি ব্লকের মধ্যে ১৬টা কিষাণমান্ডি আছে। সবগুলিতে বাজার বসে না। তার মূল কারণ, ভুল জায়গায় মান্ডি করা হয়েছে। আদিসপ্তগ্রামে কিষাণমান্ডি করা উচিত ছিল না। কারণ আদিসপ্তগ্রামের ১০টি পঞ্চায়েতের মাত্র একটা পঞ্চায়েতে চাষ হয়। মগরা ২ নম্বরে হালকা চাষ হয়। যেখানে কিষাণমান্ডি করেছে সেখানে শুধু কলার চাষ হয়। সেই কৃষকরাও বসতে চাইছে না।' এদিকে হুগলি জেলা পরষিদের সভাধিপতি মহবুব রহমান বলেন, 'আদিসপ্তগ্রামের কিষাণমান্ডিকে কী হয় আমার জানা নেই। বর্তমানে কী অবস্থায় আছে খোঁজখবর নেব।'
হুগলির বারুইপাড়ায় প্রাচীন সবজির পাইকারি বাজারে ১৫০০-র বেশি দোকান বসে। স্টেশন সংলগ্ন বাজার হওয়ায় দুরদুরান্তের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। বছর পঞ্চাশের রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, 'ভোর রাত থেকে বাজার বসে। ২০-২৫ জন কৃষকের কাছ থেকে সবজি কিনি।' চার বিঘের জমির মালিক বছর ২৫ বয়সী মিলন কোলে জানিয়েছেন, 'গ্রাম থেকে আধঘন্টার মধ্যে বাজারে চলে আসি। অন্যদিকে কৃষক বাজার যেতে সময় লাগে ২ ঘন্টা।'
হাওড়া কৃষক বাজারের অবস্থা-
হাওড়ার আমতা-১ এবং ২ নম্বর ব্লকের কৃষক বাজারগুলিও জনশূন্য। আমতা ২ কিষাণমান্ডি নির্মাণই হয়েছে অল্প বৃষ্টিতেই জলে ডুবে যাবে এমন জমিতে। স্থানীয় খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা সুনীল সাহা বলেন, 'ধান সংগ্রহ করি, কিন্তু অন্যান্য ফসল বা সবজি এখানে বিক্রি বা কেনা হয় না।' অথচ আমতার কলাতলায় ভোর থেকে কৃষকরা পাইকারি সবজির বাজারে ভিড় করে। বেচা-কেনা শেষ হয়ে যায় সকাল হতেই। এখানকার কৃষকরা কেউই কৃষক বাজারে যেতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, 'একেই কৃষক বাজারের দূরত্ব অনেকটা। তাছাড়া রাস্তার পাশের এই মাঠের পাইকেরি বাজারের নিজস্ব পরিচিত রয়েছে।'
জেলা পরিষদের সহসভাধিপতি অজয় ভট্টাচার্য আমতা ২ কৃষক বাজার পরিকল্পনার জন্য পূর্বতন বামফন্ট সরকারকে দায়ী করেছেন৷ তিনি বলেন, 'আমরা (টিএমসি সরকার) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছি। চার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছিল। একটি ভুল জায়গায় মান্ডি নির্মাণ করা হয়েছিল।' আমতা-১ কৃষক বাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এই কৃষক বাজারের সঙ্গে যোগাযোগে জন্য আমতার কলাতলা থেকে একটি বাইপাস সড়ক স্থাপন করা হবে।"
সিঙ্গুর…
সিঙ্গুর কৃষক বাজারের গল্প আগেরগুলির থেকে পৃথক। ২০০৬-এ টাটা ন্যানো প্রকল্পের বিরুদ্ধে জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের সময় ধর্ষণ ও খুন করার পর তাপসী মালিকের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। তাপসী মালিকের নামেই সিঙ্গুর কৃষক বাজার।
রাজ্য সরকারের প্রকল্প "সুফল বাংলা" সফল ভাবে রূপায়ন করার জন্য এই বাজারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষকদের কাছ থেকে সবজি সংগ্রহ করে কলকাতার সুফল বাজারের বিভিন্ন স্টলে সরবরাহ করা হয়। ফেরৎ সবজিও ফের এখান থেকে বিক্রি করা হয়।
কৃষক বাজারে কর্মরত শঙ্কর কোটাল বলেন, 'নালিকুল, সিঙ্গুর, গোপালনগর, বিলায়েতপুরের মতো এলাকার কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য এখানে বিক্রি করে। আমরা তা প্যাকেজ করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সুফল বাংলার ৬৬টি স্টলে পাঠিয়ে থাকি।' এই কৃষক বাজারে জাপানিজ ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তায় একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকান্ড চলছে। সেখানে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ফসল প্যাকেজ করে কলকাতার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলিতে সরবরাহ করা হয়।
রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী তথা সিঙ্গুরের বিধায়ক বেচারাম মান্নার বক্তব্য, 'সিঙ্গুরের কৃষক বাজার সফল বলা যায়। কিন্তু রাজ্যের বাকি কৃষি মান্ডিগুলির হাল কেন এমন তা আমি বলতে পারব না।'
Read in English