Advertisment

গণেশ নয়, কার্তিকের পাশে কলাবউ! বর্ধমানের এই বনেদি বাড়ির পুজোয় আজব রীতি

গণেশ ও কার্তিকের অধিষ্ঠানেও ব্যতিক্রমের ছোঁয়া।

IE Bangla Web Desk এবং Rajit Das
New Update
not ganesh but kalabau sitting next to karthik in the sabakar family of jamalpur , গণেশ নয়, কার্তিকের পাশে কলাবউ! বর্ধমানের এই বনেদি বাড়ির পুজোয় আজব রীতি

এই পরিবারে কলাবউয়ের অধিষ্ঠানে নতুনত্ব।

পণ্ডিত মশাই সঠিক ভাবেই পুজো করাচ্ছিলেন। কিন্তু আকন্ঠ 'কারণ সুধা' পান করে পুজো করতে বসে পূর্ব পুরুষ বলে যাচ্ছিলেন বামে গনেশায় নমঃ , দক্ষিনে কার্তিকেয় নমঃ। তা শুনে পণ্ডিত মশাই প্রতিবাদ করেন ঠিকই। কিন্তু তন্ত্রসাধক ওই পূর্বপুরুষ বাস্তবেই তখন সবাইকে দুর্গা প্রতিমায় গনেশ ও কার্তিকের স্থানবদল চাক্ষুষ করিয়ে ছিলেন। সেই থেকে ৩০০ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে বামে গণেশ ও দক্ষিণে কার্তিককে অধিষ্ঠিত রেখেই পূর্ব বর্ধমানের জামলপুরের সাদিপুর গ্রামের সভাকর বাড়িতে তৈরি হয় দুর্গা প্রতিমা। দেবীপক্ষে তন্ত্রমতে সেই প্রতিমারই পুজো পাঠ হয়। সভাকর বাড়ির এই পুজো ঘিরেই দুর্গোৎসবের কটা দিন মাতোয়ারা থাকেন সাদিপুর গ্রামের বাসিন্দারা ।

Advertisment

দামোদর নদ লাগোয়া জামালপুরের বেরুগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রাম সাদিপুর। সনাতন ঐতিহ্য মেনে এই গ্রামের সভাকর বাড়ির সাবেকি মন্দিরে হয় দেবী দুর্গার আরাধনা। সভাকর পরিবারের বর্তমান বংশধর দেবাশিষ চট্টোপাধ্যায় জানান, তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বল্লাল সেন, লক্ষণ সেনের আমলের লোক। বর্গিদের অত্যাচারে নিজ ভূমি ছেড়ে পূর্বপুরুষরা পালিয়ে চলে আসেন সাদিপুর গ্রামে। তখন থেকেই এখানেই তারা বসবাস শুরু করেন ।

দেবাশিষ বাবুর কথায় জানা যায়, তাঁদের বংশের আদি অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কালি। বংশে কালি পুজোর সূচনা কাল আরও বহু প্রাচীন। তবুও মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ মেনে তাঁদের বংশের পূর্বপুরুষ উমাচরণ চট্টোপাধ্যায় কালি বেদিতেই দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। হতদরিদ্র সাধক ব্রাহ্মণ উমাচরণ বনের পুকুরের জল, বনের ফুল, চালতার আচার আর থোড়ের নৈবেদ্য দিয়ে দুর্গা মায়ের পুজো করতেন। সেই একই রীতি মেনে বাংলার ১১১১ বঙ্গাব্দ থেকে আজও বর্তমান বংশধররা পুজো করে আসছেন।

সভাকর বাড়ির দুর্গা পুজোর অনেক কাহিনী আজও বংশের লোকজনের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। কথিত আছে বহুকাল পূর্বে বন্যার সময়ে দামোদরে পাটাতন সহ দুর্গা প্রতিমার একটি কাঠামো ভেসে আসে। স্থানীয় নাকড়া গ্রামের বর্গক্ষত্রিয় ধারা পরিবারের কয়েকজন সদস্য দামোদর থেকে সেই কাঠামোটি তুলে আনেন। তারা সেই প্রতিমা কাঠামোটি দূরের দেবীপুর এলাকায় বিক্রী করতে যাওায়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ মেনে তারা ওই কাঠামো আর দেবীপুরে বিক্রী করতে যাননি। ওই পাটাতন সহ কাঠামোটি হতদরিদ্র সভাকর পরিবারের বিধবা বধূ রতনমণি দেবীকে দিয়ে দেন। শুধু তাই নয়,পূর্ব পুরুষ উমাচরণ বাবুর সময়কালে একদল ডাকাত এক রাতের মধ্যে কাঁচা মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার একটি মন্দিরও তৈরি করে দেয়।

ওই কাঠামোতে দুর্গা প্রতীমা তৈরি করে মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালার মন্দিরে উমাচরণ দুর্গা পুজো শুরু করেন। তবে সেই সময়কার কাঁচা মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার মন্দিরটি এখন আর নেই। সভাকর বংশের বংশধররা পরে এখন ওই একই জায়গায় একটি সুন্দর পাকা দালান মন্দির তৈরি করেছেন। এখন সেখানেই পুজো হয়ে আসছে। তবে প্রতীমা কাঠামো দেওয়ার কৃতজ্ঞতা স্বরুপ সেই সূচনা কাল থেকে আজও প্রতিবছর দুর্গা পুজোয় নাকড়ার বর্গক্ষত্রীয় ওই ধারা পরিবারে বর্তমান বংশধরদেরর নৈবেদ্য পাঠান সভাকর পরিবারের সদস্যরা।

publive-image

সভাকর বাড়ির দুর্গা প্রতিমা।

পুজোর সূচনার ইতিহাস যেমন বৈচিত্র্যে ভরা তেমনি বৈচিত্র রয়েছে সভাকর বাড়ির দুর্গা প্রতিমায়। সাবেকি আমলের সেই একচালার কাঠামোয় আজও দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। তবে এই সভাকর বাড়িতে দুর্গা প্রতিমায় সাধারণ রীতির ঠিক বিপরিত অবস্থানে দেখা যায় গণেশ ও কার্তিককে। এই বাড়ির প্রতিমায় গণেশ দেবী দুর্গার ডানদিকে না থেকে বাম দিকে অবস্থান করেন। আর কার্তিক বামদিকের পরিবর্তে ডানদিকে অবস্থান করেন। তবে কলা বউকে দুর্গা প্রতিমার ডানদিকে অর্থাৎ কার্তিকের পাশে রেখেই পুজো হয়। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর অবস্থানে অবশ্য কোন পরিবর্তন নেই। এই বাড়ির প্রতিমায় দুর্গার বাহন সিংহ সাদা বর্ণের। তার মুখটি আবার ঘোড়ার মুখের ন্যায়। রায়নার মহেশ পালের পরিবার পুরুষানুক্রমে সভাকর বাড়ির এমন ব্যতিক্রমী মূর্তি তৈরি করে আসছেন।

প্রতিমায় গণেশ ও কার্তিকের স্থান বদল প্রসঙ্গে দেবাশিষ চট্টোপাধ্যায় জানান, তাঁদের বংশের এক সাধক পূর্ব পুরুষ আকন্ঠ কারণ সুধা পান করে পুজো বসেছিলেন ।পণ্ডিত মশাই তাঁকে দক্ষিনে গণেশায় নমঃ ও বামে কার্তিকেয় নমঃ বলে পুজো করতে বলেলেও তিনি ঠিক তার উল্টোটাই বলে যাচ্ছিলেন। পণ্ডিত মশাই তাঁর প্রতিবাদ করলে সাধক পূর্ব পুরুষ পণ্ডিত মশাইকে চোখ মেলে প্রতিমার দিকে তাকাতে বলেন। তখন পণ্ডিত মশাই সহ পরিবারের অন্য সবাই প্রতিমার দিকে তাকিয়ে দেখেন সত্যি দেবী দুর্গার বামে গনেশ ও ডানদিকে কার্তিক রয়েছে ।সেই থেকে বামে গনেশ ও ডানদিকে কার্তিককে অধিষ্ঠিত রেখেই সভাকর বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়ে আসছে।

সাদিপুরের সভাকর বাড়ির গৃহকর্ত্রী মানসি চট্টোপাধায় জানান, প্রতিপদের দিন থেকেই চণ্ডীপাঠ, আরতি ও ভোগ বিতরণের মধ্যদিয়ে তাঁদের বাড়ির পুজোর বোধন শুরু হয়ে যায়। নিষ্ঠা ও ভক্তিকে সম্বল করে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যদিয়ে তন্ত্র মতে মায়ের পুজো হয়। স্থানীয় পূজারী মাণিক মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পূর্বে বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা মন্দিরে কামান দাগার শব্দ শুনতে পাবার পর সভাকর বাড়িতে মহাষ্টমির সন্ধি পুজোর বলিদান হত। সেই সব এখন ইতিহাস। বর্তমানে পঞ্জিকার সাময় সারণী ধরে বলিদান হয়। দশমির দিন দধিকর্মা বিতরণ ও সিঁদুর খেলা পর্ব মিটে যাবার পর রাতে শোভাযাত্রা সহকারে দুর্গা প্রতিমা দামোদরে নিয়েগিয়ে বিসর্জন করা হয়। কোনও থিম ভাবনা ও আলোর রোশনাই হয়তো এ বাড়ির পুজোয় থাকে না। কিন্তু ভক্তিভাব ও নিজস্ব স্বকীয়তাতে সভাকর বাড়ির দুর্গা পুজো বিশেষ মাধুর্য বহন করে চলেছে।

East Bengal burdwan durgapuja 2023
Advertisment