কাকদ্বীপের মৎস্যজীবী রবীন্দ্রনাথ দাসকে খুঁজে পাওয়া গেলেও, সেখানকার রাজরাজেশ্বরপুরের ধীবর বসতিতে এখনও শোকের ছায়া। কারণ এখনও নিখোঁজ প্রায় ২০ জন মৎস্যজীবী। স্বভাবতই সেইসব পরিবারের চোখের জল কিছুতেই শুকোচ্ছে না। এদিকে রবীন্দ্রনাথ দাসের স্ত্রী বন্দনা তাঁর স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। কেন এতটা প্রাণের ঝুঁকি নিতে গেলেন তাঁরা? কেন আবহাওয়া দফতরের সতর্কতা উপেক্ষা করলেন, এই প্রশ্নগুলিই বারবার উঠে আসছে।
Advertisment
দুঃস্বপ্নের সেই শনিবারে ঘটনাস্থলে উপস্থিত জগন্নাথ দাস (রবীন্দ্রনাথের ভগ্নিপতি) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলেন, "এখনও ভয় পিছু ছাড়ে নি। সেদিনের অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর। ইলিশ ধরতে আমরা সেদিন সাগরে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর খবর আসে, আকাশের অবস্থা ভালো নয়, যখন তখন ঝড় আসতে পারে। কিন্তু আমাদের আর তখন ফিরে আসার উপায় ছিল না।" তিনি আরও জানান, "কিছুটা যাওয়ার পর ঘন মেঘে চারদিক কালো করে আসে। সমুদ্রের বুকে বইতে থাকে ঝোড়ো হাওয়া। সমুদ্র তখন ফুঁসে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাট বিরাট ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে থাকে ট্রলারে। এরপরই উল্টে যায় চারটি ট্রলার। কোনওরকমে ৩০ জনকে উদ্ধার করতে পারলেও বাকিদের খোঁজ এখনও চলছে।"
কিন্তু বাংলাদেশের জলসীমায় কীভাবে ঢুকে পড়লেন এই ভারতীয় মৎস্যজীবীরা? জগন্নাথবাবু জানাচ্ছেন, "সেদিন আমরা দিক হারিয়ে ফেলি। একটা সময় বুঝতেও পারি নি যে ভারতের জলসীমা পেরিয়ে গেছি। ঝড় থামতে হঠাৎ দেখি, দূর থেকে একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই বুঝতে পারি, বাংলাদেশের নৌসেনার জাহাজ। মনে তখন অন্য ভয় চেপে বসল, সীমা পেরিয়ে গিয়েছি তো, এবার কী হবে! অন্য কোনও বিপদ আসবে না তো? জঙ্গি ভেবে বসবে না তো? এরপর তাঁদের কাছে অনুরোধ জানাই, আমরা ঝড়ের তাণ্ডবে পথ হারিয়ে এ প্রান্তে চলে এসেছি। আমাদের উদ্ধার করুন। সব শুনে বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁরা বলেন, উপর মহল থেকে জানিয়েছে, তোমরা জলপথেই নিজেদের দেশে ফিরে যাও।"
তবে বাংলাদেশের নৌসেনা 'দেশে ফিরে যাও' বলতেই দেশে ফিরতে পারেন নি দুর্যোগ কবলিত মৎস্যজীবীরা। সেই রাতে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর জাহাজের নোঙর ধরে কাটানোর পর, ভোর রাতে সমুদ্রের পাড়ে এক অচেনা জঙ্গলে এসে তাঁদের ছেড়ে দিয়ে যায় নৌসেনা। সেখানে থেকে জঙ্গলের খাল ধরে নিজেদের দেশে ফিরে আসেন জগন্নাথ দাসেরা।
মৎসজীবী রবীন্দ্রনাথ দাসের স্ত্রী বন্দনা দাস ও তার ভগ্নিপতি জগন্নাথ দাস
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে এদিন বন্দনা দেবী বলেন, "যখন খবর আসে ট্রলার ডুবে গেছে, তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কোন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি, তা কল্পনাও করতে পারছিলাম না। এদিকে, পরিবারে আমার স্বামীই একমাত্র রোজগেরে। চিন্তায়, দুঃখে দু'চোখের পাতা এক করতে পারি নি ছয়দিন। উনি ছাড়া কেউ নেই আমাদের। বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি, দুটো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে সংসার আমার। তারপর যখন জানতে পারি, লাইফ জ্যাকেট ছাড়া জলে পাঁচ দিন ধরে ভেসে ছিলেন, আর এখন বাংলাদেশের এক হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তখন ধড়ে প্রাণ আসে।"
কিন্তু ঝড়কে উপেক্ষা করে কেন এগিয়ে গেলেন? বিপদের আভাস পেয়ে তো ফিরে আসাই উচিত ছিল। কান্নাভেজা গলায় টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে জগন্নাথবাবু বলেন, "ভয় হাতে নিয়েই আমরা এগিয়ে যাই। মালিকের মনমতো মাছ না পেলে, ফিরে আসার পর আমাদের গালমন্দ করেন, পয়সা দেন না।"