স্মার্ট ফোনের স্মার্ট জমানায় ছোট থেকেই হাতে দামি মোবাইল, সঙ্গে ইন্টারনেট কানেকশন। অনলাইন গেমে সারাদিন বুঁদ কিশোর থেকে তরুণ সমাজ। নিজেদের অজান্তেই মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনছে তারা। অন্তত মনোবিদরা তেমনটাই জানাচ্ছেন। অনলাইন গেমের চক্করে অচিরেই মানসিক ব্যাধি থেকে সাইবার জালিয়াতির শিকার হতে হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে। কতটা নিরাপদ আপনার সন্তান?
দীর্ঘ ২ বছর করোনা কালে ঘরবন্দী জীবনে কয়েকগুণ বেড়েছে কিশোর প্রজন্মের অনলাইন গেমের প্রতি আসক্তি। আর সেই আসক্তি অনেকের ক্ষেত্রেই এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে, বাধ্য হয়ে বাবা-মা’কে সন্তানকে নিয়ে ছুটতে হচ্ছে মনোবিদদের কাছে। পরিসংখ্যান বলছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মধ্যে অনলাইন গেমের প্রতি আসক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানসিক স্বাস্থ্য প্রচণ্ড ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনেকেই প্রচণ্ড খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার সারাদিন বাস্তবের দুনিয়া থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ফলে খুব সহজেই মানসিক ব্যাধির শিকার হচ্ছে কিশোর তথা তরুণ প্রজন্ম। মনোবিদরা জানাচ্ছেন অনলাইন গেমের প্রতি আসক্তির ফলে মনরোগী হয়ে যাওয়া কিশোর কিশোরীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে।
শুধু কী তাই! অনলাইন প্রতারণার ফাঁদেও পড়তে হচ্ছে তাদের। যা অনেক সময় তারা মা-বাবার থেকে এড়িয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুসারে সারা বিশ্বে অনলাইন গেমের বাড়বাড়ন্তের মাঝে ৬ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে কিশোর মনোরোগীর সংখ্যা। চিকিৎসকদের কথায়, গত ২ বছর করোনা কালে গৃহবন্দী থাকার ফলে এই হার বেড়েছে অনেকটাই।
আরও পড়ুন: < চলন্ত ট্রেনেই প্রসব যন্ত্রণায় কাহিল, মেডিকেল পড়ুয়ার দক্ষতায় ভূমিষ্ঠ ফুটফুটে কন্যা সন্তান >
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন খাস কলকাতাতেও অনলাইন গেমিয়ের পাল্লায় পড়ে বিপন্ন হচ্ছে শৈশব। তাদের ব্যবহারে পরিবর্তন আসছে। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ভাবেও নানা ব্যাধির শিকার হচ্ছেন তারা। তার মধ্যে অন্যতম, অনিদ্রা, অধিক মানসিক চাপ, উদ্বেগ, ভয়, মোবাইল অথবা কম্পিউটার ছাড়া তারা অনেকেই থাকতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে বাবা-মা বারণ করলে তাঁদের সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে। এমনকি মোবাইল বা কম্পিউটার তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে অনেকে উদ্ধত হয়ে মা-বাবাকে মারার জন্যও তেড়ে আসছে।
অনলাইন গেম কীভাবে শৈশব-কৈশরে প্রভাব ফেলেছে সে প্রসঙ্গে টার্নস্টোন গ্লোবাল (Turnstone global) এর কর্নধার তথা শিশু মনস্তত্ববিদ কাঞ্চন গাবা বলেন, “ অনালাইন গেমের প্রভাব মারাত্মক হারে বাড়তে শুরু করেছে শিশুমনে। তবে এক্ষেত্রে বাবা-মা’কে প্রথম থেকেই সন্তানদের প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। তাদের হাতে স্মার্ট ফোন ল্যাপটপ নিশ্চয় তুলে দেবেন প্রয়োজনে কিন্তু সন্তানরা যাতে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত না হয়ে পড়ে তার খেয়ালটাও রাখা জরুরি”।
তাঁর কথায়, “সন্তানদের আরও একটি সময় দেওয়া তাদের ছোট থেকে ঘরবন্দী না করে সকলের সঙ্গে মিশতে দেওয়া, সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা ভাবে কথা বলাটা একান্ত জরুরি। তিনি বলেন, আগে অধিকাংশ পরিবারই ছিল একান্নবর্তী। সেক্ষেত্রে একাকীত্ব কী সেটা আমরা সেভাবে বুঝতে শিখিনি। এখন ছোট পরিবার, কর্পোরেট লাইফস্টাইল অচিরেই আমদের মধ্যে বিপদ ডেকে আনছে ।
ডাঃ গাবা আরও বলেন, “কোভিডে আগে আমদের কাছে যত সংখ্যক বাব-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে কাউন্সিলিং করাতে আসতেন এখন সেই সংখ্যাটা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেড়েছে। গেমিংয়ের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে শিশুমনে। অনেকে নিজেরাই সেটা বুঝতে পারছে যারা বুজতে পারছে তাদের ক্ষেত্রে সেই আসক্তি কাটিয়ে ওঠা অনেকটাই সহজ। আর যারা সেটা পারছে না তাদের ক্ষেত্রে আসক্তি কাটাতে অনেকটাই সময় লেগে লাগছে। কারুর ক্ষেত্রে কাউন্সিলিং করে সুস্থ করতে ৬ থেকে ৮ মাসও লেগে যাচ্ছে”।
টার্নস্টোন গ্লোবাল (Trunstone global) এর অধীনে ‘মাইলস্টোন’ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। পরিসংখ্যান অনুসারে কোভিড পরবর্তীতে এমন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে বলে জানিয়েছে ডাঃ কাঞ্চন গাবা। তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ জন শিশুকে তাদের মা-বাবা আমদের কাছে কাউন্সিলিংয়ের জন্য নিয়ে আসছে সেই হিসাবে মাসে এই সংখ্যা ১৫ থেকে ১৬ জন।
তিনি বলেন,”তবে অনলাইন গেম মানেই যে খারাপ এমনটা নয় তার প্রতি আসক্ত হয়ে যাওয়াটা ভয়ের। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার, ‘বিহেভেরিয়াল ডিজঅর্ডার ’ সহ নানান সমস্যা গ্রাস করছে শিশুদের। তিনি জানান এই ধরণের রোগীদের জোর গেম বন্ধ করতে গেলেই নানান সমস্যা দেখা দেয়। কারুর পালস রেট বেড়ে যায় , উদ্বেগ , সেই সঙ্গে বুক ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়৷ কারুর ক্ষেত্রে মেজাজে পরিবর্তন দেখা যায়। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ চিকিৎসা এবং কাউন্সিলিং”।
অনলাইন গেম এবং সাইবার জালিয়াতি
এই ডিজিটাল যুগে যেখানে সবকিছুই আমাদের জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে, সেখানে সাইবার অপরাধের সংখ্যাও বাড়ছে হু-হু করে। সাইবার অপরাধীরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের জন্য নিত্য-নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করছে। সাইবার ক্রাইমের এক পদস্থ আধিকারিকের কথায়, ‘অনলাইন গেম এবং সেই সঙ্গে অনলাইন প্রতারণা আগের থেকে অনেকটাই বেড়েছে। বিভিন্ন উপায়ে টাকা হাতানোই অপরাধীদের মূল উদ্দেশ্য। বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ আসে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভয়ে অনেকেই বিষয়টি এড়িয়ে যান। তাছাড়াও অনলাইন গেমের মাধ্যমে, কিশোর-তরুণ দের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতানোর চক্র এখন রীতিমত সক্রিয়’।
কিভাবে অনলাইনে প্রতারণা করা হচ্ছে
সাইবার অপরাধীরা প্রতারণার জন্য অনেক নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। অনলাইন গেমের মাধ্যমেও চলছে প্রতারণা। সাইবার অপরাধীরাও অনলাইন গেমের মাধ্যমে প্রতারণার নতুন পথ আবিষ্কার করেছে। বিভিন্ন অনলাইন গেমিং অ্যাপের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রলোভন দিয়ে ব্যবহারকারীদের ডেটা এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য হাতিয়ে মুহূর্তেই সাফ হয়ে যাচ্ছে ব্যালেন্স।
চলছে প্রতারণা
যে সকল অনলাইন গেম শিশুদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় সাইবার অপরাধীরা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ভুয়া পেজ তৈরি করে এবং PUBG, ফ্রি ফায়ার এবং অন্যান্য অনলাইন গেমসের ধাঁচে ভুয়ো গেম, বিক্রি করার জন্য বিজ্ঞাপন দেয় যা গেমারদের আকর্ষণ করে। এসব বিজ্ঞাপন দেখে তাদের ফাঁদে পড়ে গেমাররা এবং প্রতারণা করা সহজ হয়ে যায়। পেজে বিজ্ঞাপন দেখে গেমাররা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
অপরাধীরা প্রথমে গেম অ্যাকসেস করতে অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করতে বলে চায় এবং পরে তাদের বাবা-মায়ের ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড নম্বর সেই সঙ্গে মোবাইলে ওটিপি চেয়ে অনলাইনে গেমের রেজিস্ট্রেশনের দাবি করে। একবার ভুল করে ফাঁদে পা দেওয়া মাত্রই সর্বস্ব খোয়া যেতে পারে।
অনলাইন জালিয়াতি এড়াতে কী করা উচিৎ
অনলাইন জালিয়াতি এড়াতে, কোনও অনলাইন গেমে আপনার ক্রেডিট কার্ড এবং ডেবিট কার্ড নম্বরগুলি সেভ করবেন না। অর্থপ্রদান করার আগে, নির্দিষ্ট মোবাইল নম্বরে OTP আসে যা কখনই অপরিচিত কারুর সঙ্গে শেয়ার করা উচিৎ নয়।