অভিশপ্ত করোনার অন্ধকার দশা কাটিয়ে দুবছর পর আশার আলো দেখছে কুমোরটুলি। উমা আরাধনায় বাকি আর মাত্র হাতে গোনা ক'টা দিন। আর, তার আগেই ব্যস্ততা বাড়ছে কুমারটুলিতে। বাধা দূর করে সবাই মিলিত হয় এই উৎসবে, দুর্গাপুজোকে ইতিমধ্যেই হেরিটেজ তকমা দিয়েছে ইউনেস্কো। ফিরছে অর্ডারের সারি। পটুয়া পাড়া জুড়ে চলছে খড়ের কাঠামোয় মাটি লেপার কাজ। কোথাও কাজ শেষ। কোথাও আবার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতি। সকাল থেকে দম ফেলার জো নেই শিল্পীদের। তবে আবহাওয়ার খামখেয়ালি কিছুটা চিন্তায় রেখেছে শিল্পীদের। দুর্গাপূজার কয়েক মাস বাকি থাকতেই কলকাতার কুমোরটুলি থেকে দেবীর মূর্তি বিদেশে পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছে। শিল্পীদের কথায় গতবারের তুলনায় বিদেশ থেকে অর্ডার বেড়েছে অনেকটাই। দুর্গামূর্তি বিদেশে পাঠানোর কাজও প্রায় শেষের পর্যায়ে। অধিকাংশ প্রতিমা পৌঁছে গিয়েছে গন্তব্যে। সামান্য কিছু পাঠানোর বাকী!
শিল্পী মালা পালের কথায়, “গত দুই বছর, মহামারীর কারণে ব্যবসা খুব খারাপ ছিল। অর্ডারের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু এ বছর ইতিমধ্যে বেশ কিছু অর্ডারের কাজ শেষের পর্যায়ে। গত বছরের তুলনায় অর্ডার বেড়েছে অনেকটাই। প্রতিমা তৈরির জন্য উত্তর কলকাতার তিনটি পূজা কমিটি আমাকে অর্ডার দিয়েছে। তবে মাটি, খড়, অন্যান্য সরঞ্জামের দাম আকাশছোঁয়া। সেক্ষেত্রে আমাদের লাভের অঙ্ক অনেকটাই কমেছে। তবে বড় ঠাকুরের চাহিদা এবার অনেকটাই বেশি। ১৬ ফুট, ১৮ ফুটের প্রতিমা অর্ডার এসেছে রেকর্ড সংখ্যায়। অর্ডার বাড়ায় পটুয়া পাড়া জুড়ে খুশির হাওয়া"।
গত ২ বছরে কোভিড কালে দুর্গা প্রতিমার উচ্চতা ১৩ থেকে ১৪ ফুটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এবার কুমোরটুলি ঘুরে চোখে পড়ল বিশাল আকারের প্রতিমার সারি। শিল্পী মন্টু পাল বলেন, " বেশিরভাগ পূজা কমিটি রথের দিন প্রতিমার অর্ডার দিয়েছে। প্রতি বছর দুর্গাপূজার আগেই, কুমারটুলি থেকে ফাইবারের দুর্গা প্রতিমা বিদেশে পাঠানো হয়। করোনা কালে সেই অর্ডার অনেকটাই কমে গিয়েছে। তবে চলতি বছর বাজার ভাল। আমি ১১টি দুর্গা প্রতিমার অর্ডার পেয়েছি যার মধ্যে পাঁচটি দুর্গা প্রতিমা যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছে। শিকাগো, নিউ জার্সি ও নিউইয়র্কে প্রতিমা পাঠানো হয়েছে। একটি দুর্গা প্রতিমা দুবাইতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও জাপান থেকেও প্রতিমার অর্ডার এসেছে। তবে মাটি, খড় সহ কাঁচামালের দাম চলতি বছর অস্বাভাবিক বেশি। সেই কারণে আমাদের খরচ বেড়েছে অনেকটাই। তবে ২ বছর পর আবার স্বমহিমায় ফিরছে দুর্গাপুজো এতেই আনন্দ"।
তিনি বলেন, ২০২০ এবং ২০২১ সালে, কোভিড মহামারীর কারণে পূজার বাজেট অনেকটাই কমেছিল বিদেশে থেকে অর্ডারও অনেকটাই কম এসেছে। ২০১৯ সালে, আমি মাত্র ৬ থেকে ৭টি প্রতিমা বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। গত বছর আমরা মাত্র দুই থেকে চারটি প্রতিমা পাঠাতে পেরেছি । মহামারীর কারণে বিদেশে আক্ষরিক অর্থেই কোনও পুজো হয়নি। এ বছর করোনা কমতেই বিদেশ থেকে ১১টি প্রতিমার অর্ডার পেয়েছি। জাপান, কানাডা এবং যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে ইতিমধ্যেই মূর্তি পাঠানো হয়েছে। কাতার এবং কলম্বিয়া থেকে মূর্তির অর্ডারও পেয়েছি,”।
তিনি আরও বলেন, “গত দুই বছরের তুলনায় ২০২২-এর পুজোতে কুমোরটুলি থেকে অন্তত ১০০ দুর্গা প্রতিমা বিদেশে যাচ্ছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে অর্ডার আসা শুরু হয়েছে। এখন, অর্ডার অনলাইনেই আসে আমাদের। ইউনেস্কো'র তরফে স্বীকৃতির পর আসা করছি এই বছর আরও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পুজোর আয়োজন হবে। এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। আমরা আশা করছি পুজোর বাজেটও বাড়বে। আমরা এ বছর ভালো ব্যবসার আশা করছি।”
কুমোর টুলির মহিলা শিল্পী চায়না পালের কথায়, "কোভিডের বাড়বাড়ন্ত কমার সঙ্গে সঙ্গে ইউনেস্কো'র স্বীকৃতি এই দুই'য়ের ওপর ভিত্তি করে পটুয়া পাড়া জুড়ে খুশির হাওয়া। ১৮ ফুটের দুর্গাপ্রতিমার অর্ডার আবার ফিরে এসেছে। বিদেশ থেকে ও জেলাগুলি থেকে অর্ডার আগের বছরের তুলনায় অর্ডার অনেকটাই বেড়েছে। প্রতিমার তৈরিতে যে খড় ব্যবহার করা হয় তার দাম ছিল ৩৫০ টাকা ১০ বান্ডিল। এখন তার জন্য গুণতে হচ্ছে ৫৫০ টাকা। আগে খড় বাঁধতে দড়ির দাম ৯০ টাকা, এখন দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫ টাকা। এমনকি কাগজ, আঠা ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে আমরা প্রতিমা সাজাই তার দাম ছিল ২০০ টাকা প্রতি বাক্স এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা। পেরেকের দাম এক সময় ৬০ টাকা থেকে ১০০টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল, এখন তা কিছুটা কমে ৮০ টাকায় নেমে এসেছে।”
আরও পড়ুন: < বুর্জ খলিফাকেও টেক্কা দেবে শ্রীভূমির ভ্যাটিকান, চোখ ধাঁধাতে তৈরি চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা >
তিনি আরও বলেন, " আমরা ইতিমধ্যেই বড় ঠাকুরের ২০ টি দুর্গা প্রতিমার অর্ডার পেয়েছি। আমি আশা করি যে আমরা এই মরশুমে ৫০টি'র মত ঠাকুর বিক্রি করব। সেই সঙ্গে আমার আশা চলতি বছর কুমোরটুলি থেকে প্রায় ৫হাজার থেকে ৭ হাজার প্রতিমা মন্ডপের পথে রওনা দেবে"।