মহিলা কামরায় অপরাধে নিশ্চিত শাস্তি, নজিরবিহীন পদক্ষেপ রানাঘাট কার শেডে

মহিলা যাত্রীরা এবার থেকে একেবারে নিশ্চিন্তে লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরায় যাতায়াত করতে পারবেন দিনরাত, সৌজন্যে পূর্ব রেলের শিয়ালদা ডিভিশনের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

মহিলা যাত্রীরা এবার থেকে একেবারে নিশ্চিন্তে লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরায় যাতায়াত করতে পারবেন দিনরাত, সৌজন্যে পূর্ব রেলের শিয়ালদা ডিভিশনের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
new Train for ladies safety Express Photo Shashi Ghosh

এই লোকাল ট্রেনেই থাকছে দুই মহিলা কামরায় অত্য়াধুনিক নিরাপত্তা ব্য়বস্থ। ছবি- শশী ঘোষ

ভারতীয় রেলে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করতে চলেছে রানাঘাট ইএমইউ কার শেড। মহিলা যাত্রীরা এবার থেকে একেবারে নিশ্চিন্তে লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরায় যাতায়াত করতে পারবেন দিনরাত, সৌজন্যে পূর্ব রেলের শিয়ালদা ডিভিশনের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রানাঘাট কার শেডের আধিকারিক ও কর্মীরা। দেশে এই প্রথম লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরায় থাকছে আপৎকালে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য 'প্যানিক বাটন', এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যালার্ম সিস্টেম।

Advertisment

ভারতের কোনো প্রান্তেই লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরায় এই ধরনের অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বলে দাবি করছেন রানাঘাট ইএমইউ কার শেডের আধিকারিকরা।

new Train for laides safety Express Photo Shashi Ghosh এই কামরায় চড়লে নিশ্চিত নিরাপত্তাই শুধু নয়, মন ভাল হওয়ার গ্যারান্টিও রয়েছে। ছবি: শশী ঘোষ

২০১৫ সালের মার্চ মাসে রানাঘাট কলঙ্কিত হয়েছিল ৭১ বছর বয়সী এক খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীর গণধর্ষণের ঘটনায়। রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে সেই ঘটনা তোলপাড় তুলেছিল বিশ্বেও। চার বছর পর সেই রানাঘাটেরই রেলওয়ে ইলেকট্রিক্যাল কার শেড মহিলা যাত্রীদের নিরাপত্তায় যুগান্তকারী পদক্ষেপের সাক্ষী থাকতে চলেছে। যদিও আগের ঘটনার সঙ্গে রেলের বিন্দুমাত্র কোনও যোগ নেই, তবে ইতিহাস বোধহয় এভাবেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। একই জায়গা, দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক।

Advertisment

আপাতত একটি ট্রেনেই বসানো হয়েছে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু এই মডেল ট্রেন সফল হলেই দেশের নানা প্রান্তের লোকাল ট্রেনে ওই সিস্টেম কার্যকরী করা হবে। শুধু প্যানিক বাটন বা অ্যালার্ম সিস্টেম নয়, এছাড়াও সিসিটভি ক্যামেরা দিয়ে মুড়ে ফেলা হচ্ছে মহিলা কামরা। এবং সাধারণ যাত্রীদের সুবিধের জন্য এক্সপ্রেস ও মেইল ট্রেনের মত লোকাল ট্রেনের গায়েও থাকছে ইলেকট্রিক্যাল ডিসপ্লে বোর্ড।

new Train for laides safety Express Photo Shashi Ghosh রানাঘাটের রেলের এই কার শেডেই লোকাল ট্রেনের দুই মহিলা কামরায় অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ছবি: শশী ঘোষ

একনজরে দেখে নেওয়া যাক কী কী থাকছে এই ১২ বগির এই ট্রেনে। এক: প্যানিক বাটন, দুই: সিসিটিভি, তিন: ইলেকট্রিক্যাল অ্যালার্ম সিস্টেম, চার: ইলেকট্রিক্যাল ডিসপ্লে বোর্ড, পাঁচ: ১২ টি বগিতে পাঁচটি মোটর, ছয়: দুটি বগিতেই চোখ ধাঁধানো গ্রাফিতি।

এখন পর্যন্ত দেশের কোনও লোকাল ট্রেনে 'প্যানিক বাটন' সিস্টেম নেই, এমনটাই জানিয়েছেন রানাঘাট কার শেডের সিনিয়র ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সুপ্রিয় কুমার রায়। কীভাবে কাজ করবে এই বোতাম? তিনি জানান, প্রতিটি মহিলা কামরার ভিতরের দুই প্রান্তে দুটি প্যানিক বাটন আছে। বোতাম টিপলেই মোটরম্যান ও গার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হবে। তারপর বোতামের পাশে থাকা স্পিকারে সংশ্লিষ্ট যাত্রী তাঁর অসুবিধার কথা জানাতে পারবেন। ওপাশ থেকে তার জবাবও মিলবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন অনায়াসে। সহজেই ধরা পড়তে পারে অপরাধী। কাজেই এই বোতাম দুষ্কৃতীদের মধ্যেই প্যানিক ছড়াতে বাধ্য।

new Train for laides safety Express Photo Shashi Ghosh এই হচ্ছে প্যানিক বাটন। ছবি: শশী ঘোষ

অবশ্য শুধু প্যানিক বাটনের ওপর ভরসা করে নেই রেল। নানা পদ্ধতির মাধ্যমে মহিলা যাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর রেল কর্তৃপক্ষ। অতএব থাকছে 'ইলেকট্রিক্যাল অ্যালার্ম সিস্টেম'। এর কাজ কী? রেলওয়ে আধিকারিকদের ব্যাখ্যা, যে কোনও ট্রেনে হঠাৎ বিপত্তি ঘটলে চেইন টেনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে দেন যাত্রীরা। কিন্তু দেখা গিয়েছে, অনেক সময় সেই চেইন কাজ করে না, মূলত দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে। সেক্ষেত্রে কিন্তু এই অ্যালার্ম সিস্টেমে বার্তা পৌঁছে যাবে ট্রেনের চালক ও গার্ডের কাছে। তাঁরা যাত্রীর বক্তব্য জেনে চটজলদি ব্যবস্থা নিতে পারবেন। প্রয়োজনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে দেবেন তাঁরা।

Train Inner pic express photo Shashi Ghoshtrain live footage-001 সিসিটিভির লাইভ ফিড এভাবে মোবাইলে দেখবেন রেলের আধিকারিক ও নিরাপত্তা অফিসাররা।

নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি এখানেই শেষ নয়। এই ট্রেনের দুটি বগিতেই দেখা গেল সিসিটিভি ক্যামেরা। এক একটি কামরায় ছ'টি করে ক্যামেরা রয়েছে, যার ফলে গোটা কামরাটিই এই ক্যামেরাগুলির নজরে রয়েছে। কামরার যে কোনো স্থানে অপ্রীতিকর কিছু ঘটলেই তা ধরে ফেলবে সিসিটিভি। শুধু তাই নয়, ঘটনার লাইভ ফুটেজ মোবাইল ফোন মারফত সহজেই পৌঁছে যাবে সংশ্লিষ্ট আধিকারিক ও কর্মীদের কাছে। অর্থাৎ কোনো দুষ্কর্ম করে পালানোর সুযোগ নেই এই ট্রেনের মহিলা কামরা থেকে। নিমেষে ব্যবস্থা নিতে পারবে রেল।

new Train for laides safety Express Photo Shashi Ghosh এই হচ্ছে অ্যালার্ম বাটন। এটি টিপলেই যোগাযোগ হয়ে যাবে রেলের চালক ও গার্ডের সঙ্গে। ছবি: শশী ঘোষ

লোকাল ট্রেনের সামনে-পিছনে না দেখে বোঝার উপায় নেই কোন ট্রেন। গন্তব্য কোথায়। এবার এই তথ্য জানার সহজ উপায় রয়েছে এই ট্রেনে। ট্রেনের গায়ে থাকছে 'ইলেকট্রিক্যাল ডিসপ্লে বোর্ড', যা বর্তমান লোকাল ট্রেনে থাকে না। কোথায় যাবে ট্রেন, নির্দিষ্ট গন্তব্য জ্বলজ্বল করবে ওই বোর্ডে। দৌড়ঝাঁপ করার প্রয়োজন পড়বে না। জানালা দিয়ে "দাদা, কোন ট্রেন?" জিজ্ঞেস করার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আর ট্রেনের ভিতরের আঁকা ছবি যেন কথা বলছে। অপরূপ সেসব শিল্পকর্ম যাত্রার ক্লান্তি লঘু করতে যথেষ্ট। এ এক অন্য ধরনের অনুভূতি এনে দেবে যাত্রীদের। এক দৃষ্টে আঁকা ছবি দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন।

new Train for laides safety Express Photo Shashi Ghosh মহিলা কামরায় ওঠা পুরুষরা সাবধান হয়ে যান। ছবি: শশী ঘোষ

এখন শুধু সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষা। তারপর হনহনিয়ে ছুটবে ট্রেন। রানাঘাটের এই কার শেডে মাত্র এক মাসের মধ্যে সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। দিনরাত এক করে রেলের কর্মীরা এই কাজ শেষ করেছেন। নিজে সর্বক্ষণ থেকে তদারকি করেছেন সুপ্রিয়বাবু। ইতিমধ্যে রেলের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা এই ট্রেন পরিদর্শন করে গিয়েছেন। যেদিন অনুমতি মিলবে, সেদিনই রানাঘাটের প্রায় ৮ হাজার স্কোয়ার মিটারের কারশেড থেকে নিজের গন্তব্য়ে রওনা দেবে ট্রেনটি। ১২ বগির এই ট্রেনের কোচ তৈরি হয়েছে চেন্নাইয়ের ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে।

পরিশেষে, এই স্টিম শেড দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ ছিল। ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে নবরূপে ইলেকট্রিক্যাল কার শেড হিসেবে এটির উদ্বোধন হয়। এবার এখান থেকেই ট্র্যাকে চলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে দেশের প্রথম অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত লোকাল ট্রেন।

indian railway