Advertisment

হল না শেষ দেখা, ভিনরাজ্যে বাঙালি যুবকের জেল মুক্তির আগেই প্রয়াত বাবা

বাংলাদেশি অভিযোগে বেঙ্গালুরুর জেলে বন্দি মৃতের পুত্র-পুত্রবধূ ও নাতি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Father and Son

ছবির ক্যাপশন- মৃত পঙ্কজ অধিকারী ও তাঁর ছেলে পলাশ, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে।

শ্রমিকের কাজ করতে বেঙ্গালুরু গিয়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে সেখানকার জেলে বন্দি রয়েছে ছেলে ও বৌমা। রেহাই পায়নি তাঁদের দেড়বছর বয়সি শিশুপুত্রও। ছেলে,বৌমা ও নাতিকে বেঙ্গালুরুর জেল থেকে মুক্ত করে পশ্চিমবঙ্গের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আট মাস ধরে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বাবা পঙ্কজ অধিকারী। আইনি লড়াই চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এই অসহায় পিতা আর মানসিক চাপ নিতে না-পেরে বেঙ্গালুরুতেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

Advertisment

ছেলে,বৌমা ও প্রিয় নাতিকে বেঙ্গালুরুর জেলে ফেলে রেখেই পঙ্কজবাবু মঙ্গলবার বাংলায় নিজের বাড়িতে ফিরলেন ঠিকই। তবে নিথর দেহ হয়ে। দুই মেয়ে সাথী ও শম্পা এদিন স্থানীয় শ্মশানে তাঁদের বাবা পঙ্কজবাবুর অন্তেষ্টিক্রিয়া করেছেন। সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় এক পিতার এমন মৃত্যু শোকাতুর করে তুলেছে তাঁর পরিজন ও প্রতিবেশীদের ।

বেঙ্গালুরুর জেলে বন্দি থাকা দম্পতি পলাশ অধিকারী ও শুক্লা অধিকারী পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার জৌগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার তেলে গ্রামের বাসিন্দা। সেখানে রয়েছে তাঁদের টিনের চালার দু’কুঠুরি ভাঙাচোরা বাড়ি। ওই বাড়ি দেখলে যে কেউ বুঝে যাবেন দারিদ্রই অধিকারী পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী। পলাশদের মতোই তাঁদের প্রতিবেশীদেরও একই হাল। মাথা গোঁজার ঠাইটুকুই শুধুমাত্র তাদের সম্বল। তাদের বেশিরভাগই দিন মজুরির কাজ করে অন্নের সংস্থান করেন। বাকিদের কেউ বালাপোশ তৈরি, আবার কেউ বিড়ি বাঁধার কাজ করে উপার্জন করেন। এমনই এক গ্রামের ছেলে পলাশ রোজগারের আশায় স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গত বছরের জুন মাসে গিয়েছিলে ব্যাঙ্গালুরু। কিন্তু উপার্জন করা তো দূরের কথা ,উল্টে সেখানে তাঁদের পরিণতি হয় ভয়ংকর।

তেলে গ্রামেই বসবাস করেন পলাশ অধিকারীর আত্মীয় পিন্টু হাওলাদার । তিনি বলেন, “শ্রমিকের কাজ করার জন্য শিশু পত্রকে সঙ্গে নিয়েই পলাশ তাঁর স্ত্রী ব্যাঙ্গালুরু যায়। একই উদ্দেশ্যে পালাশের বাবা পঙ্কজ অধিকারী, মা সবিতাদেবী ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারীও ব্যাঙ্গালুরু যান। সেখানকার মারাথাহাল্লি মহকুমার ভারথুর থানার সুলিবেলে গ্রামের কায়েন খাঁনের ডেরায় তাঁরা ওঠেন। সেখানে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরির শর্তে কায়েন খাঁনের অধীনে তাঁরা কাজ করা শুরু করেন। তাদের কাজ ছিল হোটেল, রেঁস্তোরা, সিনেমা হল সহ বিভিন্ন জয়গা থেকে সংগৃহীত বর্জ্য, প্লাস্টিক সরঞ্জাম কুড়িয়ে আনা।

পিন্টু হাওলাদার বলেন, “পলাশরা ব্যাঙ্গালুরু যাবার পর প্রথম দিকে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল ।হঠাৎ করেই ওই বছরের ২৭ জুলাই ভারথুর থানার পুলিশ কায়েন খাঁনের ডেরায় হানা দেয়। সেখানে যাঁরা যাঁরা বাংলাভাষী ছিল তারা সবাই নাকি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী,এমন সন্দেহে ভারথুর থানার পুলিশ পলাশের পরিবার সহ আরও পাঁচ জনকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যায়। ওই সময়ে পলাশ, তাঁর স্ত্রী, বাবা-মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী, সবাই ভারথুর থানার পুলিশকে জানান তাঁরা কেউই বাংলাদেশী নন। তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে জানিয়ে নিজের নিজের আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড দেখান। সেইসব দেখে সেখানকার পুলিশ পলাশের বৃদ্ধ বাবা,মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারীকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্রের রেহাই মেলেনি। ভারথুর থানার পুলিশ বাংলাদেশী অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে প্রায় আট মাস হয়ে গেল শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে পলাশ ও তাঁর স্ত্রী ব্যাঙ্গালুরুর জেলে চোখের জল ফেলেই দিন কাটাচ্ছে বলে পিন্টু হাওলাদার জানিয়েছেন।"

প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী বলেন, "আমিও রোজগারের আশায় পলাশদের সঙ্গেই ব্যাঙ্গালুরু যাই। সেখানে ভারথুর থানার পুলিশ আমাকেও বাংলাদেশী অনুপ্রেবশকারী সন্দেহে ধরে। ওখানকার পুলিশের সঙ্গে আমাদের কথা বলার ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা হচ্ছিল। ওরা আমাদের কথা যেমন বুঝতে পারছিল না, তেমন আমরাও ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবুও আমি,পলাশের বাবা, মা ও পলাশ বাংলা ভাষাতেই ভারথুর থানার পুলিশকে বারেবারে বলে যাই আমরা ভারতীয়, পশ্চিমবাংলার বর্ধমানের বাসিন্দ। তেলে গ্রামে থাকা আমার স্ত্রীর ফোন নম্বার ওরা চাইলে সেটাও আমি দিয়েদি।এ র পর ওরা কি বুজলো জানিনা। আমাকে এবং পালাশের বাবা ও মাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে পলাশ এবং তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে ছাড়ে না। তদের জেলে পাঠিয়ে দেয়। বাবা ও মা ভারতীয় বলে ব্যাঙ্গালুরু পুলিশের কাছে গন্য হল,অথচ ওই বাবা মায়ের ছেলে , বৌমা ও নাতি কিভাবে বাংলাদেশী হয়ে গেল সেটা আজ অবধি বুঝতে পারছি না।"

হুগলির বৈচিগ্রাম নিবাসী পলাশের ভগ্নিপতি সুজন হালদার বলেন, “পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের এমন করুণ পরিণতির কথা জেনে তিনি ব্যাঙ্গালুরু পৌছান। কিন্তু কোন ভাবেই কিছু সুরাহা করতে পারেননি। যে আইনজীবীকে নিযুক্ত করেছেন তার কাছ থেকেও আশানুরুপ সহযোগীতা পাচ্ছেন না।" তেলে গ্রাম নিবাসী জৌগ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য কৃষ্ণা সরকার বলেন, “পলাশ ও তাঁর পরিবারের সবাই তেলে গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। এখানকার ভোটার। তার পরেও ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ কোন যুক্তিতে পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে গ্রেফতার করল সেটাই কারোর বোধগম্যে হচ্ছে না বলে পঞ্চায়েত সদস্য মন্তব্য করেছেন।"

জামালপুরের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার বলেন, “ভারথুর থানার পুলিশের তিন জন আধিকারিক আমার দফতরে আসে। পলাশ অধিকারী ও তাঁর স্ত্রী প্রকৃতই ভারতীয় নাগরিক কিনা এবং তাদের ভোটার ও আধার কার্ডটি সঠিক কিনা সেইসব বিষয়ে বেঙ্গালুরু পুলিশ আমার কাছে জানতে চায়। এছাড়াও পলাশদের পারিবারিক পরিচিতি, কতদিন তারা তেলে গ্রামে বসবাস করছে,তাদের কাস্ট স্ট্যটাস সহ নানা বিষয়ে তারা জানতে চায়। এইসব বিষয়ের তথ্যও তারা যাচাই করে। দম্পতির ভারতীয় নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত সব তথ্য ভারথুর থানার মেইল আইডি তে পাঠিয়েও দেওয়া হয়।"

আরও পড়ুন- ‘শিক্ষার বাবারও পিন্ডি চটকিয়েছেন!’ প্রয়াত পিতার পর উদয়নের নিশানায় সেলিম

বিডিও এও জানান, “ভারথুর থানার তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকরা শুধু জামালপুরের বিডিও অফিস ও থানায় তথ্য যাচাই করে ফিরে যান, এমনটা নয়। বেশ কয়েকদিন ধরে ওই পুলিশ আধিকারিক দল জামালপুরের দলিল রেজিস্ট্রি অফিস,ভূমি দফতরের অফিস ,জৌগ্রাম পঞ্চায়েত এমনকি বর্ধমান দক্ষিন মহকুমা শাসকের অফিসে গিয়েও ওই দম্পতির নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য যাচাই করে নিয়ে গিয়েছে। এতকিছুর পরেও পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশু পুত্র বেঙ্গালুরুর জেল থেকে কেন মুক্তি পাচ্ছেন না সেটাই আশ্চর্য্যের।"

Death father Youth
Advertisment