Advertisment

Premium: কলকাতার এই প্রবীণ সংগ্রহ করেন উনিশ শতকের অমূল্য সব 'সুচ-সুতোর' ভালোবাসা

এঁদের মতো সংগ্রাহকের প্রচেষ্টাতেই হয়তো সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে অতীতের অমূল্য সম্পদ।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
Parimal Roy have collected many art forms of the past

বাড়ির বারান্দায় পরিমল রায়। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

কেউ বলেন পাগলামি, আবার কেউ বা বলেন নেশা। সংগ্রাহকরা চিরকাল এমনই। এনারা আছেন বলেই হয়তো সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে অতীতের অমূল্য সম্পদ। এই শহরে এমন বহু সংগ্রাহকই আছেন। দলিলদস্তাবেজ, মুদ্রা, পোর্সেলিন, পুতুল, পেতলের বাসন, মূর্তি, ডাকটিকিট, চিঠি, বিখ্যাত মানুষদের সই, চাবির রিং, বুকমার্ক, পেনসিল, দেশলাই— এমন আরও কত কী রয়েছে তাঁদের সংগ্রহে। পরিমল রায় এদের মধ্যেই একজন। ভবানীপুর এলাকার ইদানিংকালের আধুনিক বাড়ি গুলোর মাঝে একটি খুদে গলির ভিতরে আদ্যিকালের বাড়িটি যেন ইতিহাস আগলে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ির সব থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা পরিমলবাবু। বাড়িতে ঢোকার সময়েই মনে হবে এ যেন পুরনো কলকাতা! প্রথমেই নজর কাড়বে পুরনো দিনের এনামেলের সাইন বোর্ড! দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন দেশের মুখোশ আর পেইন্টিং! ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে কোণার ঘরেই পরিমলবাবুর পৃথিবী। বয়স ৮৮ বছর হলেও স্মৃতিশক্তিতে এখনও জং ধরেনি। এখনও গড়গড়িয়ে বলেন পুরনো দিনের সব গল্প।

Advertisment

ছোট্ট ঘরেই অবলীলায় দাঁড়িয়ে সময়। টেবিলে, দেওয়ালে, তাকগুলোতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে আঠারো ও উনিশ শতকের জীবন্ত ইতিহাস। সত্যজিৎ রায়ের ছবির পোস্টার, অবনী ঠাকুরের মেয়ের হাতে বানানো রবীন্দ্রনাথের কবিতার দেওয়াল অ্যাপ্লিকা। কাগজ কেটে বানানো দেওয়াল ছবি। অতি আশ্চর্য এক জিনিস। বহুমূল্যবান। যদিও পরিমলবাবুর সংগ্রহের মূল বিষয় সূচিশিল্প। উনিশ শতক এবং বিশ শতকের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক শিল্পকলা।

publive-image
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ

একটু খোলাসা করেই এই অবলুপ্ত শিল্পটি নিয়ে বলা যাক। 'চারুলতা'র প্রথম দৃশ্য মনে পড়ে? ষাটের দশকে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা! দৃশ্যের শুরুতেই প্রথমে উঠে আসে ছবির কুশীলবদের নাম, তখন চারু ব্যস্ত থাকে স্বামী ভূপতির রুমাল সেলাইয়ে। তার নিপুণ সুচ-সুতো চালনায় এমব্রয়ডারি হুপ বা কাঠের বেড়ি বরাবর ইংরেজি অক্ষর 'বি'র চার পাশ ঘিরে ফুটে ওঠে পাতার মোটিফ। শুধু চারুলতা বললে খানিক ভুল হবে। 'পরশপাথর', 'মণিহারা', 'সমাপ্তি' এবং 'ঘরে বাইরে' ছবিতেও সত্যজিৎ নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গরমণীর এই অসাধারণ গার্হস্থ শিল্পকলাকে। একটা সময় ছিল যখন শেলাইয়ের কাজ শেখা ছিল বাড়ির মেয়েদের বাধ্যতামূলক। উনিশ শতকের সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়া শিল্পের ধারাটি আজ অবলুপ্ত। শেলাইয়ের কাজ কেমন হয়, হয়তো এখন অনেকেই জানে না।

publive-image
নিজের নানা সংগ্রহের মাঝে পরিমল রায়।এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ

আরও পড়ুন- ‘তারার ছায়া’য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম

পুরনো শেলাই শিল্প কেমন ছিল তা জানাতেই একের পর এক সংগ্রহের শুরু এই প্রবীণের। এই মুহূর্তে পরিমল রায় পূর্ব ভারতের সেরা এফেমেরা (ক্ষণস্থায়ী জিনিস) সংগ্রাহক। কয়েন, ডাকটিকিট, ফিল্ম পোস্টার, বুকলেট, লবি স্টিল, এনামেল সাইনবোর্ডের পর এখন তাঁর মন-প্রাণ জুড়ে মা-মাসি-পিসি-দিদা-ঠাকুমাদের হারিয়ে যাওয়া শিল্পকর্ম। বাল্য বয়স থেকে সংগ্রহের নেশা শুরু। পরিমল রায় যদিও নিজেকে সংগ্রাহক বলতে আপত্তি করেন। তার কথায়, "শৈশবকাল থেকে সব মানুষই শিল্পী। সবার মধ্যেই শিল্পসত্তা রয়েছে। সেটা সংগ্রহই হোক কিংবা অন্য যা কিছু। বড় হওয়ার সাথে কিছু মানুষ সে সব ভুলে যায় আর কিছু সেগুলোই নিয়েই চলে। আমার সংগ্রহ করাটাও এরকম। কোন জিনিস পাওয়ার পর থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সিকড়ে পৌঁছাতে পারছি আমি ততক্ষণ ওই জিনিস নিয়েই পরে থাকি। এটাই আমার আনন্দ।"

publive-image
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ

একটা সময় পর্যন্ত অনেক নানা রকম জিনিস সংগ্রহ করেছেন পরিমল রায়। বয়সের ভারে এখন অনেক কিছু সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। সংগ্রহের মোটামুটি আশি শতাংশ জিনিসই দিয়ে ফেলেছেন। শেলাই সংগ্রহগুলোই সব নিজের কাছে রাখা আছে। সেলাই সংগ্রহ নিয়ে বলতে গিয়ে পরিমলবাবু বলেন, 'আগেরকার সময়ে পয়লা বৈশাখ এবং পুজোর আগে বছরে দুবার ঘরের ঝাড়াই-সাফাই হত। এরকমই কোন এক সময়ে বছর চল্লিশ আগে, হঠাৎ সিঁড়ির ঘর থেকে আবিষ্কার করলাম কাঠের ফ্রেমে বন্দি মা-ঠাকুমার আমলের দশটি সুচ-সুতোর কাজ। বেশির ভাগই ড্যাম্প লেগে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শুধু তিনটে বাঁচানো গেল। ছবির নীচে 'সুষমা' নাম দেখে বুঝলাম এ গুলি আমার বড়দির করা, তাঁর বিয়ের আগে।'

publive-image
বাড়ির গলিতে পুরনো দিনের এনামেলের সাইন বোর্ড!এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ

আরও পড়ুন- আদি থেকে আধুনিক, কলকাতার ‘ক্যামেরাম্যান’-এর জিম্মায় এক স্বর্ণালী ‘ইতিহাস’

তখনই পরিমলের মনে হল, আজকের দিনের মেয়েদের এ সব করার সময়ও নেই, আর করার প্রয়োজনও তেমন হয় না। তাই এই সব আর তৈরি হওয়ার কোন সম্ভবনাও নেই। অথচ একটা সময় ছিল যখন বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিয়ের পাত্রপক্ষের কাছে পরীক্ষা দেওয়ার সময় দুটি প্রশ্ন অবশ্যই করা হত। 'মা তুমি রাঁধতে জানো?' আর 'সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ পারো?' যে মেয়ে ক'দিন পরে সন্তানের জন্য মোজা-কাঁথা তৈরি করবে, তাকে নমুনা হিসাবে তখন পেশ করতে হত সুচ-সুতোর কিছু কাজকর্ম। তাতে কখনও থাকত দেবদেবী বা মনীষীর ছবি, কখনও পশুপাখি, আবার কখনও কোনও কবিতার লাইন। দুর্ভাগ্যে মা ঠাকুরমার আমলের এসব জিনিস এখন আর তৈরি হবে না। যাদের বাড়িতে এখনও সেলাইয়ের কাজ রয়েছে সেগুলির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বেশির ভাগই চলে গিয়েছে ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে। কাঠের ফ্রেম আর কাচ বেচে যদিও বা তাদের কিছু টাকা পাওয়া যায় সেলাইয়ের জন্য কারও আগ্রহ না থাকায় সেগুলি ফেলে দেওয়া হত। তাই আশালতা, কনক, রিণা, রেবার মতো শিল্পীদের কেউ আর মনেই রাখত না।

publive-image
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ

বর্তমানে সেলাইয়ের যত সংগ্রহ আছে সবই পরিমল রায় জোগাড় করেছেন ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে, একটু একটু করে জমিয়ে তুলেছেন সূচিশিল্পের এক অমূল্য ভাণ্ডার। সাধারণ কাপড়, ক্রস স্টিচ, রেশম এবং অ্যাপ্লিক মিলিয়ে এখন তাঁর কাছে এখন অনেক শিল্পকর্মই রয়েছে। কিছুর বয়স একশোরও বেশি। সব সুচিশিল্পই এখন ফ্রেমে বাঁধানো। বৃদ্ধ বয়েসেও সংগ্রহের আনন্দে মেতে আছেন। প্রতিমুহূর্ত নবীনদের জন্যে সংরক্ষিত করে যাচ্ছেন অমূল্য সম্পদ।

kolkata news West Bengal Museum
Advertisment