সবে মুক্তি মিলেছে নাগাড়ে হয়ে চলা বৃষ্টি থেকে। কিন্তু জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে হাঁসফাঁস অবস্থা মধ্যবিত্তের হেঁশেলে। জোড়া বিপত্তিতে আনাজ বাজার আগুন। ছুঁলেই ছ্যাঁকা খাওয়ার জো! দম ছুটেছে সাধারণের। বর্ষা থেকে হেমন্ত নাগাড়ে হওয়া বৃষ্টির কারণে বিঘের পর বিঘের জমির আনাজে ‘আগুন’ লেগেছিল। সঙ্গে অসুর রূপে হাজির ডিজেল। কলকাতায় ডিজেল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। রোজই বাড়ছে পেট্রল- ডিজেল দাম।
অতি বর্ষণে এমনিতেই ফলন নষ্ট হওয়ায় জোগানের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে আনাজের আকাশছোঁয়া দাম। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জ্বালানির মাশুল। চাষির ঘর থেকে বাজারে আনাজ-সবজি পৌঁছাতে ভরসা ‘ছোট হাতি’। এদিকে ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচা বেড়েছে অনেকটাই। এই নিয়ে ইতিমধ্যেই বিক্ষোভ দেখিয়েছে বিভিন্ন ট্রাক মালিক সংগঠনগুলি। উৎসব আবহে পাহাড় থেকে সমতল অগ্নিমূল্য বাজার। ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে মধ্যবিত্ত বাঙালির। একে করোনার রক্তচক্ষু বিশ্ব অর্থনীতির নাজেহাল অবস্থা। তার মধ্যেই জ্বলছে বঙ্গের আনাজ-বাজার।
এক ধাক্কায় আনাজের দাম বেড়েছে অনেকটাই। প্রতি কেজি ১০ থেকে ২০ টাকা দাম বৃদ্ধির ছ্যাঁকায় হাঁসফাঁস অবস্থা সকলের। পুজোর সময় ফি-বছরই বাজারের দাম কিছুটা চড়া থাকে। তবে এবার তা রেকর্ড করেছে। যদিও এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে জ্বালানিকেই দুষছেন আনাজ ব্যবসায়ীরা। তাঁদের কথায়, পরিবহন খরচ বেড়েছে অনেকটাই, সেই সঙ্গে নাগাড়ে বৃষ্টির কারণে অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে, তাই ‘আগুন’ লেগেছে বাজারে।
এক আনাজ ব্যবসায়ী সুশান্ত দেবনাথের কথায়, "বৃষ্টির কারণে অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। সেই সঙ্গে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণেই বাজারের এমন আগুন হাল।" ভোজন রসিক বাঙালির পাতে কমেছে হরেক রান্নার পদ। কেউ কেউ আবার অন্য খাতের খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। কসবার বাসিন্দা রমা গুহ জানিয়েছেন, "করোনাকালে এমনিতেই মানুষের রোজকার তলানিতে ঠেকেছে, তার উপর ‘আগুন আনাজে’ সংসার চালানোই দায়।"
পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গেই ব্যবসায়ীরা আগুন বাজারের আরেকটি কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন উৎসব আবহে রাস্তায় চাঁদার জুলুম। অন্যসময় একগাড়ি আনাজ পরিবহনের খরচ যেখানে থাকে ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫ থেকে ৬ টাকার কাছাকাছি। এসবের মাশুলও গুনতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারকে।
পাইকারি বাজারের সঙ্গে খোলা বাজারের আনাজের দামের বিস্তর ফারাক নজরে এসেছে। পাইকারি বাজার অপেক্ষা কলকাতার বিভিন্ন খোলা বাজারের দামের তফাৎ প্রায় ২০ থেকে ২৫ টাকার কাছাকাছি। একই ছবি জেলাগুলিতেও। কোলে মার্কেটের এক ব্যবসায়ী সাগর দাস বলেন, "এখান থেকে কলকাতার বিভিন্ন বাজারে আনাজ পরিবহন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে, যার মাশুল গুনতে হচ্ছে বাজার করতে আসা মধ্যবিত্তকে।"
দুই ২৪পরগনা, হাওড়া, হুগলীর বিভিন্ন বাজারের চিত্রটাও একই। দুর্গাপুজোর আগে পটল, সিম, বেগুন, বিনস, ভেন্ডির দাম যা ছিল এখন তা বেড়েছে প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। কোথাও আবার ২০ টাকা।
কলকাতা বিভিন্ন বাজারের ছবিও এক। যে পটল মাস খানেক আগে ছিল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা। সেই পটলই এখন ৮০ থেকে ৯০ টাকায় দেদার বিকচ্ছে। একলাফে ২০ টাকা দাম বেড়েছে ঢেঁড়সের। কেজি প্রতি ঢেঁড়স এখন ৭০ টাকা। ঝিঙে ৬০ টাকা প্রতি কেজি। বেগুন ৭০ থেকে ৮০ টাকা প্রতি কেজির দর। ক্যাপসিকাম দারুণ ফর্মে রয়েছে। প্রতি কেজি ক্যাপসিকামের দর ১৫০ টাকা। লঙ্কা ১০০ টাকা প্রতি কেজি। চন্দ্রমুখী আলু প্রতি কেজির দাম ২৫ টাকা। পেঁয়াজ প্রতি কেজির দাম ৪৫ টাকা। ধনেপাতা প্রতি কেজির দাম ৪০০ টাকা। ভাল লাউ গোটা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। শসা ৫০ টাকা। করলা প্রতি কেজির দাম ৮০ টাকা। একপিস ফুলকপি ৫০ টাকা।
এই নিয়ে শিয়ালদহ পাইকারি বাজারের এক ব্যবসায়ী মহাদেব দাস জানান, "গতবছরের তুলনায় এই বছর পরিবহন ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, একথা যেমন ঠিক তেমন এটাও ঠিক চাষিরা সেইভাবে ফসলের দাম পাচ্ছেন না"। তাঁর কথায় অবিলম্বে পেট্রল ডিজেলের হাল ধরতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে, নাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে'।
যেভাবে রোজ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পেট্রোপণ্যের দাম তাতে এই দাম আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন ভেন্ডার সমিতিগুলি। কবে শীতের মরশুমের তাজা আনাজপাতি আসবে তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে মধ্যবিত্ত বাঙালি। তবে তাতে রেহাই মিলবে না বলেই মনে করছেন শিয়ালদহের বাসিন্দা সুব্রত দত্ত, তাঁর কথায়, "যেভাবে পেট্রল ডিজেলের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রান্নার গ্যাসের দাম, তাতে হেঁসেলের আগুন নিভবে বলে মনে হয় না।"
করোনাকালে বাজারে গিয়ে পকেটে টান সাধারণ মানুষের৷ প্রায় সব জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছে৷ পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ছে নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর৷ তার মধ্যে রান্নার গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
পেট্রোলের লিটার ১১০ টাকা ছাড়িয়েছে। সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে ডিজেল। রান্নার গ্যাস হাজার টাকা ছুঁইছুঁই। রাস্তা থেকে রান্নাঘর। জ্বালানির লাগাতার দাম বৃদ্ধিতে জেরবার সাধারণ মানুষ। তবে দীপাবলির উপহার হিসাবে বুধবার সন্ধেয় পেট্রল-ডিজেলের দাম কমিয়েছে কেন্দ্র। পেট্রলের উপর ৫ টাকা এবং ডিজেলের উপর ১০ টাকা আবগারি শুল্ক কমানোর কথা জানিয়েছে কেন্দ্র। কার্যকর হবে বৃহস্পতিবার থেকে। তবে তাতে বাজারের পরিস্থিতি বদলাবে কি না তাতে সন্দিহান ব্যবসায়ী থেকে আম জনতা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন