খুচরো বাজারে আলুর দর বেড়ে যাওয়ায় নাজেহাল সাধারণ মানুষ। এমনকী দর বেঁধে দেওয়ার জন্য নবান্নে বৈঠকও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেন বেড়েছে এবারে আলুর দর? কী বলছেন কৃষক, আলু সংরক্ষণকারী ও ব্যবসায়ীরা? রাজ্য সরকারের একটা বিজ্ঞপ্তিও বাজারে আলুর দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলেও অনেকে মনে করছেন। খুচরো ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, বেশি দামে আলু কিনতে হচ্ছে। যদিও আলুর সংরক্ষণকারীরা এই বক্তব্য মানতে নারাজ।
স্কুল শিক্ষা দফতরের মিড ডি মিলের এক পাতার বিজ্ঞপ্তি আলুর দর বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করছেন আলু মজুতকারীরা। কী ছিল সেই বিজ্ঞপ্তিতে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে অগাষ্ট মাসে ২৮ টাকা কেজি দরে ১ কেজি আলু ক্রয়, সঙ্গে ২ কেজি চাল ও ১টা সাবানের কথা উল্লেখ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য সভাপতি সাগর দে বলেন, "ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়ার পর আলু সংরক্ষণকারীরা সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে অগাস্ট মাসে হিমঘর থেকে আলু বের করবে। একেই এবছরে হিমঘরে আলুর পরিমান অন্য বছরের তুলনায় কম রয়েছে। স্বভাবতই দাম বাড়তে বাধ্য।" ওই বিজ্ঞপ্তি প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের কাছে সরকার বলেছে কলকাতার খুচরো বাজারের কথা বলা হয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন তাহলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়নি কেন।
সূত্রের খবর, এবছর হিমঘরে আলু রাখার পরিমান অনেকটাই কমেছে। ২০১৭ সালে ১৪ কোটি ৩২ লক্ষ প্যাকেট লোড হয়েছিল। ২০১৮ সালে ১৪ কোটি ৪ লক্ষ প্যাকেট, ২০১৯ সালে ১২ কোটি ৬৯ লক্ষ প্যাকেট রাখা হয়েছিল। এবার হিমঘরে আলু রাখা হয়েছে (২০২০ সাল) ১১ কোটি ৪০ লক্ষ প্যাকেট। তার মধ্যে ১০ শতাংশ বীজ আলু।
আলু ব্যবসায়ী সমিতি জানিয়েছে, সরকার তাঁদের অনুরোধ করেছে ২৩ টাকা কেজি পাইকেরি দর রাখার জন্য। আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকারের মিড ডে মিল দফতর অর্ডার বের করেছে ২৮ টাকা কেজি দরে আলু কিনবে। তাই মানুষ আরও বিভ্রান্ত হচ্ছে। সংরক্ষণকারীদের কথায়, ২০১৬ সালের দুর্গাপুজোর সময় থেকে একেবারে ২০১৯ সালের দুর্গাপুজো পর্যন্ত কৃষক ও সংরক্ষণকারীরা ব্যাপক ভাবে লোকসান করেছে। যার ফলস্বরূরপ যেসব ব্যবসায়ীরা দাদন দিয়ে (বীজ, সার) কৃষকদের সাহায্য করে। তাঁরা তা করতে পারেনি। ২০২০ তে সারা ভারতেই আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। বাইরের রাজ্য়ে হিমঘরে ৬৫ থেক ৭০ শতাংশের বেশি আলু লোড হয়নি। আর বাংলায় ৭৮ থেক ৮০ শতাংশ আলু লোড হয়েছে। সারা ভারতেই আলুর দাম বেশি আছে।
আলুর দাম বৃদ্ধির পিছনে যে কথা বলা হচ্ছে, এখন কোল্ড স্টোরেজে ঝাড়াই-বাছাই এক নম্বর আলুর দর কেজি প্রতি ২৪ টাকা। অ্যাভারেজ আলু ২৩ টাকা কেজি। চন্দ্রমুখী আরও ২ টাকা বেশি। ২৪ টাকা দামের পর বহণ খরচ। মাঝে হাতবদল। ব্যবসায়ী সমিতি মনে করছে, এবার আর আলুর দাম কমার তেমন একটা সম্ভাবনা নেই। সাগরবাবু বলেন, "গতবছরের মত বৃষ্টির পরিস্থিতি হলে শেষের দিকে আলুর দাম আরও বাড়বে। তা নাহলে এমনই চলবে। দাম কমবে যে তা কিন্তু নয়। কারণ স্টক বেশি নেই।" তিনি হিসাব দিয়েছেন, অগাস্টের মধ্য়ে ৫০ শতাংশ আলু বেরিয়ে যাবে। তারপর ৫০ শতাংশ আলু, এখন জানুয়ারিতেও পুরনো আলু বিক্রি হয়। ১০ শতাংশ বীজ আলু থেকে যাবে। এছাড়া গতবছরের থেকে ১০ শতাংশ প্যাকেট কম লোড হয়েছে।"
এত কম মজুত হওয়ার কারণ কী?
ব্যবসায়ী, সংরক্ষণকারী ও কৃষক ২০১৬ সালের পর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আলুতে ব্যাপক হারে লোকসান খেয়েছে। যার জন্য দাদন দিয়ে চাষ করানোর ক্ষমতা ছিল না। কৃষকদেরও পুঁজি ছিল না বলে চাষ কম হয়েছে। এটা সারা ভারতের চিত্র। সারা ভারতের তুলনায় বাংলায় ১০ শতাংশ বেশি লোড হয়েছে। তাতে ১০০ শতাংশ ক্যাপাসিটির মধ্য়ে উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, গুজরাটে ৬০ থেক ৬৫ শতাংশ আলু মজুত হয়েছে। বাংলায় হিমঘরে মজুুত হয়েছে ৭৫ থেক ৭৮ শতাংশ আলু। উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ আলু রাখতে হবে বীজের জন্য। তাছাড়া বাংলার আলু বিহার, ঝাড়খন্ড, ওড়িষা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও আসামে যায়। এবছর আলুর চাহিদাও বাড়ছে। এদিকে বাজারে অন্য সবজির দামও বেশ চড়া।
রবিবারও খুচরো বাজারে আলুর দর ছিল বেশ চড়া। ৩০ টাকা কেজির নীচে কোথাও আলু মেলেনি। টাস্ক ফোর্সের সদস্য রবীন্দ্রনাথ কোলে বলেন, "পাইকেরি দর ২০-২১ টাকা হলে খুচরো বাজারে ২৫ টাকা কেজি আলু দেওয়া যেতে পারে। আর মিড ডে মিলের বিজ্ঞপ্তি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে আগামী কাল কথা বলব।" তবে আলু ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, "সরকার ২৩ টাকা পাইকেরি দর দিতে বলেছে সেটা দেওয়ার চেষ্টা হবে। তবে ২৩-২৪ টাকার আলু কীভাবে বাজারে ৩০টাকা বা তার বেশি দর হয় তা আমাদের জানা নেই।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন