তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন দাতব্য চিকিৎসালয়। সেই চিকিৎসালয়টি ফের চালু করতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন শতায়ুর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া এক বৃদ্ধ। গরিব ও দুঃস্থদের চিকিৎসার স্বার্থে পূর্ব বর্ধমানের বৃদ্ধের আপোশহীন এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন প্রত্যেকে।
পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। বয়স ৯৩ ছুঁয়েছে, বার্ধক্যে শারীরিক শক্তি কমলেও কমেনি তাঁর মনের জোর। এই মনের জোরকে সম্বল করেই গ্রামের তালাবন্ধ প্রাচীন দাতব্য চিকিৎসালয় ফের চালুর জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি । অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক শুরুদাসবাবু মূলত আইনি পথে ও সামাজিকভাবে জনমত গড়ে তুলে এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। দুঃস্থদের চিকিৎসার স্বার্থে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই লড়াই জারি রাখার ব্যাপারেও দৃঢ় প্রত্যয়ী তিনি। পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দারাও এই লড়াইয়ে বৃদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আজ থেকে ১০৫ বছর আগে ১৯১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাঁচড়া গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয় নামে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উদ্বোধন হয়। এলাকাবাসীর স্বার্থে এই চিকিৎসালয়টি তৈরির ব্যাপারে সেই সময় মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন গ্রামেরই বধূ হৈমবতী মুখোপাধ্যায়। তাই তাঁর নামেই চিকিৎসালয়টির নামকরণ হয়। ব্রিটিশ রাজত্বে তৎকালীন বর্ধমানের ডিভিশনাল কমিশনার ডি. এইচ . লিস (D .H. Lees) হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টির উদ্বোধন করেছিলেন।
শুরুর দিকে এখানে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, কমপাউন্ডার স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজে যুক্ত ছিলেন। এমনকী এখানে রোগীদের ভর্তি রেখেও চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। পাঁচড়া গ্রাম ছাড়াও এই চিকিৎসালয়ে ফি দিন ভিড় জমে যেত আশেপাশের গ্রামগুলির বাসিন্দাদের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চিকিৎসালয়টির মানোন্নয়ন ঘটবে বলেই মনে করেছিলেন এলাকাবাসী। কিন্তু তা আর হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সময় যত গড়ায় এই চিকিৎসালয়ের পরিষেবাও ততই দুর্বল হতে শুরু করে। পরে অবিভক্ত বর্ধমান জেলা পরিষদ চিকিৎসালয়টি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল জেলা ভাগ হয়। তারপরেও পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে একজন মাত্র চিকিৎসকের উপর নির্ভর করে চলছিল হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টি।
২০২০-এর ৩১ ডিসেম্বর ওই চিকিৎসকও অবসর নেন। তার পর থেকেই এই দাতব্য চিকিৎসালয়টি তালা বন্ধ হয়েই পড়ে রয়েছে। সেই কারণে এখন চিকিৎসা পরিষেবা পেতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে পাঁচড়া সহ আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের। এখন চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার জন্য এলাকার বাসিন্দাদের যেতে হচ্ছে ১০ কিমি দূরে জামালপুর ব্লক হাসপাতাল অথবা ১২ কিমি দূরের মেমারি গ্রামীণ হাসপাতালে। অনেককে এই এলাকা থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও যেতে হয়।
আরও পড়ুন- গরমে নাজেহাল দশা থেকে রেহাই, আজ বৃষ্টি হতে পারে এই জেলাগুলিতে
পাঁচড়ার বাসিন্দা রাজু ঘোষ ও শ্রীকান্ত নন্দীরা জানালেন, হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে পাঁচড়া-সহ আশেপাশের বহু গ্রামের বাসিন্দা চিকিৎসা পরিষেবা পেতেন। আগে এখানে প্রতিদিন গড়ে আড়াইশো-তিনশোজন চিকিৎসার জন্য আসতেন। তবে বর্তমানে দাতব্য চিকিৎসালয়টি তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে । বাধ্য হয়েই চিকিৎসার জন্য দূরের হাসপাতালগুলিতে যেতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণেই চিকিৎসালয়টি চালু করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
দাতব্য চিকিৎসালয়টি চালুর দাবিতে স্থানীয়রা পথ অবরোধ থেকে শুরু করে নবান্নে চিঠি পর্যন্ত লিখেছেন। কিন্তু রাজ্য সরকারও বিষয়টি নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি বলে পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ। তবে এবার গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টি ফের চালুর জন্য উদ্যোগী হয়েছেন। গুরুদাসবাবুর এই লড়াইয়ে পাঁচড়ার বাসিন্দারাও তাঁর পাশে রয়েছেন।
হাসপাতালটি চালুর জন্য কলকাতা হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। এরই পাশাপাশি সামাজিকভাবে জনমত গড়ে তুলেও চিকিৎসালয়টি চালুর দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জনস্বার্থে হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয় চালুর জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই লড়াই চালিয়ে বলে জানিয়েদেন দৃঢ় প্রত্যয়ী এই বৃদ্ধ।
এই লড়াইয়ে গুরুদাসবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁর স্ত্রী রেখাদেবী এবং কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী তাঁর দুই ছেলে রবিশংকর ও উদয়শংকর চট্টোপাধ্যায়। গুরুদাসবাবুর ছেলে রবিশংকর চট্টোপাধ্যায় বলেন ,“সরকার যাতে পাঁচড়ার শতাব্দী-প্রাচীন হৈম্যবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টি অধিগ্রহণ করে সেই দাবিতে বাবা জনস্বার্থ মামলা করেছেন। এই মামলা সংক্রান্ত রিপোর্ট আদালতে পাঠানো নিয়ে গড়িমশি করার জন্য স্বাস্থ্য দফতরকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে কলকাতা হাইকোর্ট।''
এরই পাশাপাশি রবিশংকর বাবু আরও জানান, এই মামলায় সরকার পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী তপন মুখোপাধ্যায় আদালতে জানান, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়তে ন্যূনতম ৩০ হাজার জনসংখ্যা প্রয়োজন। সেখানে পাঁচড়ার জনসংখ্যা ২২ হাজার বলে জানান সরকার পক্ষের আইনজীবী। এই প্রসঙ্গে রবিশংকর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ''২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পাঁচড়ার ওই জনসংখ্যা ধরলে হবে না। কিসের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য দফতর পাঁচড়ার ওই জনসংখ্যা দাবি করা হচ্ছে তার রিপোর্ট রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও পূর্ব বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে আদালত চেয়েছে
।''
যদিও বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বলে জানিয়ে প্রতিক্রিয়া এড়িয়েছেন পূর্ব বর্ধমান জেলা স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরা। একইভাবে জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বাগবুল ইসলামও এব্যাপারে কিছু বলতে চাননি।