মণীষীদের ছবি ও বাণী লেখা রংচঙে স্কুল ঘর আছে। পড়ুয়া আছে, শিক্ষকও আছেন। নেই শুধু
স্কুলের অধিকাংশ শ্রেণী কক্ষের মাথার উপর ছাদ। তাই মাথার উপর ছাদ থাকা অবশিষ্ট একটি মাত্র শ্রেণী কক্ষে গাদাগাদি করে বসেই শিক্ষকের কাছে পাঠ নিতে হয় পড়ুয়াদের। আর আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলেই ছুটি হয়ে যায় স্কুল। এটা কোনও গল্প-কথা নয়। বাস্তবেই দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই ভাবেই চলছে পূর্ব বর্ধমানের রায়না ১ ব্লকের হাকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের এই দুর্দশা কবে কাটবে তা কারও জানা নেই। প্রশাসন ও স্কুল শিক্ষা দফতর কবে নড়েচড়ে বসে সেদিকেই তাকিয়ে আছেন শিক্ষক, অভিভাবক, পড়ুয়া ও গ্রামবাসীরা।
রায়না ১ ব্লকের হাকৃষ্ণপুর গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার আলোকে আনার লক্ষে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা পায় হাকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। শুরুর পর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল বিদ্যালয়টি। কিন্তু ২০২০ সালের মে মাসে হওয়া আমফান ঝড়ের তাণ্ডবে সব কিছু ওলোটপালোট হয়ে যায়। ঝড়ের দাপটে উড়ে যায় বিদ্যালয়ের একাধিক শ্রেণীক্ষের উপরে থাকা টিনের চালা।
আরও পড়ুন- ইডির চোখা-চোখা প্রশ্ন সামলে সটান মন্দিরে নুসরত, পুজো দিয়ে ফিরলেন বাড়ি
তার পর থেকে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু শ্রেণীকক্ষ গুলির মাথার উপরের চালা আর পুনর্নির্মাণ হয়নি। তাই বৃষ্টি নামলেই জলে ভাসে বিদ্যালয়। তবে জল ঝড়ের মধ্যেও অক্ষত রয়ে আছে বিদ্যালয়ের দেওয়ালে আঁকা থাকা মনীষীদের ছবি। তার পাশে আজও জ্বলজ্বল করছে পড়ুয়াদের উদ্দেশ্যে লেখা “বই পড়ব, পড়ে শিখব, আরও জানব", এই মূল্যবান কথাগুলি। কিন্তু তাতে আর কি যায় আসে আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলেই ছুটি হয়ে যাওয়া স্কুলের পড়ুয়াদের!
বিদ্যালয়ের টিচার ইনচার্য সঞ্জীব কুমার সোম এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমফান ঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্যালয়ের তিনটি শ্রেণী কক্ষের টিনের চালা উড়ে যায়। ওই চালা পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করার জন্য রাজ্য ও জেলা প্রশাসন, শিক্ষা দফতর সহ নানা মহলে আবেদন নিবেদন করা হয়েছে। সুরাহা আজও মেলেনি। তাই মাথার উপর ছাদ থাকা বিদ্যালয়ের সর্বশিক্ষা মিশনের একটি মাত্র ঘরে প্রি-প্রাইমারি থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ৪২ জন পড়ুয়াকে গাদাগাদি করে বসাতে হয়। ওই ঘরেই চলে লেখাপড়া।" সম্প্রতি পঞ্চায়েত সমিতি একটি ঘরের জন্য অর্থ বরাদ করেছে। সেই ঘরের নির্মান কাজ এখন চলছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন- পুলিশে বিরাট রদবদল মুখ্যমন্ত্রীর, ঢালাও বদলি SP-দের, কোন জেলায় দায়িত্বে কে?
আকাশে মেঘ দেখা দিলেই স্কুল ছুটি দিয়ে দিতে হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে টিচার ইনচার্য বলেন, “অভিভাবকরা আমাকে বলে দিয়েছেন আমাদের স্কুলে মিডডে মিল রান্নার ঘরটি ভালো থাকলেও একাধিক শ্রেণী কক্ষের মাথার উপর ছাদ নেই, চালাও নেই। বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হলে পড়ুয়াদের বিপদ হতে পারে। এই আশঙ্কা করেই অভিভাবকরা বলে দিয়েছেন, আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখলেই পড়ুয়াদের ছুটি দিয়ে দিতে হবে। তাই বৈশাখ থেকে ভাদ্র, এই পাঁচ মাস আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলেই পড়ুয়াদের ছুটি দিয়ে দিতে হয়।"
তিনি আরও বলেন, "স্কুলের দুরবস্থার জন্য অভিভাবকরা আমাদের স্কুল থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পাশের স্কুলে তাঁদের ছেলে মেয়েদের ভর্তি করাচ্ছেন। তাই আমাদের স্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা দিন দিন কমছে।" স্কুলটির হাল ফেরাতে শিক্ষা দফতরের সহযোগিতা চাইছেন টিচার ইনচার্য সঞ্জীব কুমার সোম।
এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা আক্ষেপ করে জানান, একসময়ে হাকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁরা পড়াশোনা করেছেন। এখন সেই বিদ্যালয়ের দুরাবস্থা দেখে তাঁদেরও কষ্ট হয়। বিদ্যালয়ে যে কজন পড়ুয়া রয়েছে তাদেরও কষ্টের শেষ নেই। স্কুলে মাত্র দু’জন শিক্ষক। শ্রেণী কক্ষের অভাবে চার-চারটে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের একটা ঘরে গাদাগাদি করে বসিয়ে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকরা। স্কুলের চারপাশে পাঁচিল পর্যন্ত নেই। পরিকাঠামোগত এসব ঘাটতির কারণে এলাকার অভিভাবকরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের আর এই স্কুলে ভর্তি করাতে চাইছেন না। স্কুলটির হাল ফেরাতে প্রশাসন ও শিক্ষা দফতরকে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে আবেদন জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
আরও পড়ুন- মায়ের সঙ্গে বচসায় ‘রক্তগঙ্গা’ বইয়ে দিল ছেলে! ঘটনা জানলে গায়ে কাঁটা দেবে!
এলাকাবাসীর মতোই রায়না ২ চক্রের স্কুল পরিদর্শক (এস আই) শ্রাবন্তী ঘোষও হাকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুরবস্থার কথা স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, “আমফান ঝড়ে বিদ্যালয়ের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর ছবি-সহ সব তথ্য আমি জেলা শিক্ষা দফতর সহ জেলা প্রশাসনের সব মহলে পঠিয়েছি। এমনকী স্কুলের বর্তমান সমস্যা ও দুরাবস্থার বিষয়েও সবিস্তার রিপোর্ট আমি সব মহলে জমা দিয়ে রেখেছি। এখন কি ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেই বিষয়টি নিয়ে আমিও অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মতোই প্রতীক্ষায় আছি।" জেলা পরিষদের সভাধিপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার সব শুনে বলেন, “কিছুদিন হল আমি দায়িত্ব পেয়েছি। স্কুলটির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। স্কুলের টিচার ইনচার্য যদি আমাকে লিখিতভাবে সবিস্তার জানান আমি অবশ্যই স্কুলটির উন্নতিতে পদক্ষেপ নেব।"
আরও পড়ুন- ‘মারাত্মক তথ্য’ পেয়েই নারদে গা ঝাড়া CBI-এর? তড়িঘড়ি তলব ম্যাথু স্যামুয়েলকে
জেলার বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র বলেন, "এই রাজ্যের তৃণমূল সরকার খেলা, মেলার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে। ক্লাবের দুর্গাপুজোর জন্য মোটা টাকা অনুদান দেয়। বিধায়কদের মাইনে একধাপে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহু আবেদন নিবেদন করেও সরকারের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পাচ্ছে না। তৃণমূল সরকারের কাছে এটাই প্রত্যাশিত।"