শ্যামা'র ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করে বর্ধমানের দর্শকদের মোহিত করল স্বামীকে নৃশংস ভাবে খুনের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দি মনুয়া। জেল বোধহয় এই কারণেই সংশোধনাগার। তাই প্রেমিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বামীকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত মনুয়াও এখন পরিণত হয়েছে কবিগুরুর একান্ত ভক্তে। শুধু ভক্তই নয়। অতীত ভুলে বারাসতের হৃদয়পুরের বাসিন্দা এই বন্দি, মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শ্যামা'র ভূমিকায় নৃত্যও পরিবেশন করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিল। এভাবেই মনুয়া যেন প্রমাণ করতে চাইল, এখন সে সংশোধিত হওয়ার পথে। নৃত্যশিল্পী এই বন্দির ভূয়সী প্রশংসা করে দর্শকরাও না-বলে পারলেন না, পাঁকেই তো পদ্মের জন্ম হয়। রত্নাকরও তো বাল্মিকী হয়েছিলেন।
২০১৭ সালের ২ মে রাতে বারাসতের হৃদয়পুরে নিজের বাড়িতেই খুন হন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সংস্থায় কর্মরত অনুপম সিংহ। পরের দিন দেহ উদ্ধার করে তদন্তে নামে পুলিশ। খুনের ১৩ দিনের মাথায় প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে বারাসত থেকে মনুয়া মজুমদার (সিংহ) এবং তার প্রেমিক অজিতকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, অজিতের সঙ্গে মনুয়ার বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জেরেই অনুপমকে নৃশংস ভাবে খুন করে অজিত। মাথায় ভারী অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে অনুপমকে খুন করা হয়েছিল। খুনের দিন তাঁর স্ত্রী মনুয়া বাপের বাড়িতে থাকলেও ঘটনার সময় প্রেমিক অজিতের মোবাইলে ফোন করে অনুপমের আর্তনাদ শুনেছিল। তদন্তকারীরা এ-ও জানতে পারেন, খুনের ঘটনার দিন অর্থাৎ ২ মে দুপুরে ওই বাড়িতে গিয়েছিল মনুয়া ও তার প্রেমিক অজিত। পরে মনুয়া বাপের বাড়ি ফিরে গেলেও অজিত ওই বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল। অনুপম আসতেই তাকে আক্রমণ করে অজিত। লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা থেঁতলে অনুপমকে খুন করা হয়।
স্বামীকে খুনের ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় মনুয়ার। সেই ঘটনা সাড়া ফেলে দিয়েছিল সারা রাজ্যে। দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে প্রথম ঠাঁই হয় মনুয়া মজুমদারের। পরে ২০২১ সালে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে আনা হয় বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। জানা গেছে, দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে থাকাকালীন 'দমদম রেডিও'তে রেডিও জকির ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল মনুয়াকে। মহিলাদের ক্রিকেটে স্কোরারের ভূমিকাতেও ছিল। নৃত্যশিল্পী হিসেবেও সংশোধনাগারে সে নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল।
বর্ধমান সংশোধনাগারে বন্দি হয়ে থেকেও নিজের প্রতিভার স্ফূরণ দেখিয়েছে এই বন্দি। যেন বোঝাতে চেয়েছে, ২০১৭ সালের ওই ঘটনা এখন তার কাছে অতীত। নিজের প্রতিভার স্ফূরণ ঘটাতে সে বেছে নিয়েছে কবিগুরু এবং নৃত্যকেও। শুক্রবার রাতে বর্ধমানের উৎসব ময়দানে নৃত্য পরিবেশন করে মনুয়া দর্শকদের তারিফ কুড়োয়। এর আগে কখনও 'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে' আবার কখনও 'আলোকের এই ঝর্নাধারায়' …. নৃত্য পরিবেশন করে দর্শকদের মোহিত করেছে বন্দি মনুয়া।
কারা দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, মনুয়ার মধ্যে প্রতিভা আগে থেকে ছিল। সংশোধানাগারে বন্দিদের নানাভাবে ভিন্ন জীবনের ছোঁয়া দিতে চান তাঁরা। দেওয়া হয় নৃত্য প্রশিক্ষণ। এখানে প্রশিক্ষণ দেন মেহবুব হাসান। তরুণ মেহবুব ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও পরিচিত। এই প্রশিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি জেল থেকে প্রকাশিত 'মুক্তমনে' পত্রিকার সম্পাদকও এখন মনুয়াই। মেহবুব জানাচ্ছেন, মনুয়ার মধ্যে প্রতিভার প্রকাশ আগে থেকেই ছিল। তাদের কাছে সব ছাত্রীই সমান। তবে মনুয়া সব দিকে থেকে এগিয়ে থাকা এক ছাত্রী। তার মধ্যে এক কুশলী নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনাই রয়েছে।
আরও পড়ুন- শিংয়ে তুলে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীকে আছড়ে মারল ষাঁড়, তারপর?
বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে স্থানান্তরের পরে সেখানেও নানা কর্মসূচিতে যুক্ত থাকার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল মনুয়া। মহিলা আবাসিকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বাংলা সাহিত্যে তার দখল রয়েছে। সে কারণে জেল সুপার মনুয়াকে ‘মুক্তমনে’-র সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন। জেলে মনুয়া এখন মহিলা আবাসিকদের নিয়ে নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকে। এবছর জেলে দুর্গাপুজো উপলক্ষে সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠান হয়েছে। সেখানে কেউ আবৃত্তি করেছেন, কেউ গান গেয়েছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটি নৃত্য আলেখ্য পরিবেশিত হয়েছে, 'মহিষাসুর বধ' নিয়ে। তাতেও মনুয়ার বিশেষ ভূমিকা ছিল। এখন মনুয়াই যেন সংশোধনাগার শব্দের বাস্তব প্রতীক হয়ে উঠেছে বলেই মনে করছেন কারা আধিকারিকরা।