এখানে রামমন্দিরের কোনও দাবি নেই, তা নিয়ে মাথাব্যাথাও নেই। তবে এই অযোধ্য়ায় কাজের দাবি আছে। আগে নিজেদের মাওবাদী পরিচয় দিতে যাঁরা ভয় পেতেন এখন তাঁরা মাওবাদী ছিলেন বলে প্রকাশ্যে দাবি করছেন। কারণ, তাঁদের দরকার একটা সরকারি চাকরি। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের উসুলডুংরি গ্রামে একসময় মাওবাদী ও পুলিশের আনাগোনা চলতেই থাকত। গ্রামের অনেকেই জঙ্গলপার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। নির্বাচনের মুখে উসুলডুংরি ঘুরে দেখল ইন্ডয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।
Advertisment
শোনা যায়, একসময় মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল ছিল পুরুলিয়ার এই পাহাড়িয়া গ্রাম। অযোধ্যার এই উঁচু অংশ দিয়ে দূর-দূরান্ত স্পষ্ট দেখা যায়। গ্রামে তিন মাওবাদী যুবকের সরকারি চাকরি জুটেছে। চাকরির আশায় গ্রামের অন্য যুবকরা নিজেরাই ঘোষণা করে বলছে তাঁরাও মাওবাদী কার্যকলাপে যুক্ত ছিলেন। অস্ত্র জমা দিয়েছেন বলেও দাবি করছেন। তাঁদের দাবি, একটা সরকারি চাকরির। কিন্তু সরকারি চাকরি কোথায়? এদিকে গ্রীষ্মে গ্রামের নলকূপগুলি থেকে জল ওঠে না। এখনও অপরিস্কার পুকুর ও ইঁদারার জলই ভরসা অযোধ্যার উসুলডুংরি গ্রামের বাসিন্দাদের। পেশা বলতে জঙ্গল থেকে কুড়ানো কাঠ বিক্রি।
এক্সপ্রেস ফটো- পার্থ পাল
অযোধ্যার উসুলডুংরিতে এলে আদি, প্রস্তর, মধ্যযুগের কথা মনে পড়তে পারে। এই গ্রামের তালপাড়া, টুডু পাড়া, নামো পাড়া, স্কুল পাড়া, হরটোকা, মাঝডুংরিতে প্রায় ১২০পরিবারের বসবাস। একদিকে আইফোনের মডেল বদলে যাচ্ছে, নিত্য বদলাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা, আর এখানকার বাসিন্দাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানের কোনও বদল নেই। গ্রামের অধিকাংশই আদিবাসী। কিন্তু কী বলছে পাহাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দারা?
Advertisment
গরু জঙ্গলে চড়ানোর কাজের ফাঁকে মাধ্যমিক পাস করেছেন উকিল মান্ডি। একদিকে বাবার মৃত্যু, টাকা পযসার অভাব, বেশিদূর পড়তে পারেননি তিনি। পনেরো কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতেন উকিল। উকিলের পরিবারে রয়েছে মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান। উচ্চমাধ্যমিক ফেল ২৬ বছরের উকিল মান্ডির দাবি, "আমি মাওবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। অস্ত্র জমা দিয়েছি। কিন্তু আমি চাকরি পাইনি। কিষানজির সঙ্গেও সাক্ষাত হয়েছিল। একসময় মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কাকা মনসারাম মান্ডি ছাড়া গ্রামের আরও দুজন সরকারি চাকরি পেয়েছেন। আমি হেঁটে হেঁটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের কালীঘাটের বাড়িতেও গিয়েছিলাম দাবি জানাতে। ঝামেলা বেধেছিল নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে। এখন জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে কোনওরকমে দিনাতিপাত করছি।" প্রাক্তন মাওবাদী পরিচয় দিয়ে চাকরির দাবি করলেন কালীপদ মান্ডি, সুনীল মান্ডি। কালীপদ, সুনীলের বক্তব্য, "আমরাও ছিলাম সেই আন্দোলনে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে এসেছি। কিন্তু কোনও চাকরি জোটেনি। সেই অপেক্ষায় রয়েছি।" টুডু পাড়ার রাখহরি টুডু(৬০) বলেন, "মাওবাদীরা মিটিংয়ে ডেকে নিয়ে যেত। রাতে পুলিশ আসত। একদিকে মাওবাদী অন্যদিকে পুলিশের টহল। ভয়েই দিন কাটত আমাদের।"
এক্সপ্রেস ফটো- পার্থ পাল
এখানে মূল জীবিকা জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ। তারপর সেই কাঠ ২৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ী রাস্তায় সাইকেলে অথবা মাথায় করে হাটে গিয়ে বিক্রি করা। কাঠের দর ২৫ কেজি ১০০ টাকা। এভাবে মাসে রোজগার প্রায় ১,৬০০টাকা। কারও একটু বেশি। ১২০ পরিবার রয়েছে এই গ্রামে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার বছর সাতচল্লিশের বুধুলাল বেসরার। বুধুলালের কথায়, "বৃষ্টি হলে বছরে একবার এক বিঘে জমিতে ধান, ভুট্টার চাষ হয়।" স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে শৌচালয়ের তিন দিকে দেওয়াল, টিনের দরজা নীচে পড়ে রয়েছে, প্যান বসানো হয়নি। দেখালেন বুধুলাল।
ভরদুপুরে দেখা গেল গ্রামের মহিলারা ইঁদারা থেকে জল থেকে কলসী করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। এই জল দিয়েই রান্না-খাওয়া। তাছাড়া গরমে ভরসা বলতে যে পুকুরে স্নান করে গ্রামের লোক সেই পুকুরের জল। এর ফলে পেটের সমস্যাও হয়। পঞ্চায়েত বা প্রাশসনকে বলেও কোনও সুরাহা মেলেনি। উসুলডুংরি গ্রামের বাসিন্দাদের সকলের একই অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য, "বর্ষা ছাড়া টিউবয়েল থেকে জল ওঠে না। অগত্যা, ইঁদারা ও পুকুরের জলই খেতে হয়।" গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে আছে জিরিহিরি ঝর্ণা। মানব সভ্যতা এগিয়ে চলে, ভোট প্রক্রিয়ায় ভর করে এগোয় গণতন্ত্র, উসুলডুংরির বাসিন্দাদের জীবনযাপনে কোনও পরিবর্তন ঘটে না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন