শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশের নজর এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজরিত বিশ্বভারতীর দিকে। অভিযোগ উঠছে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে নিয়ে, তিনি বিজেপির প্রতিনিধি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চেয়ার’-এ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বসা নিয়েও কম উত্তাপ ছড়ায়নি। সেখানে উন্নয়ন কি আদৌ হচ্ছে? না কি শুধুই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকছে এই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়? অন্যদিকে দেশের অন্যত্র দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরির উদ্যোগ চলছে জোরকদমে। বিশ্বভারতীর সামগ্রিক হালচাল নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে শান্তিনিকেতনে পূর্বপল্লির বাসভবনে খোলামেলা কথা বললেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। আজ প্রকাশিত হল সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্যায়।
এখানে কোনও রাজনৈতিক দলকে কোনও সুবিধা দিই না। প্রধানমন্ত্রী এখানে এসেছিলেন রাজনৈতিক প্রচারে। আমি কিন্তু আমাদের মাঠে হেলিকপ্টার নামতে দিইনি। আমি বলেছিলাম আচার্য হয়ে এলে নিশ্চয় কপ্টার নামতে দিতাম। আমাদের এখানকার দু’জন সাংসদ, তাঁরা হিতাকাঙ্খী, তাঁরা কোর্টের মেম্বারও। তাঁদের ফ্রিতে জায়গা দিইনি দলের কাজে আসায়। বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে এলে আদর-যত্ন করব। শ্রীনিকেতনে আমাদের ক্যাম্পাসে মতুয়াদের মিটিং বন্ধ করে দিয়েছি। দলের মিটিং চলবে না। আজ মতুয়া সভা করলে কাল অন্যরা এলে বারণ করতে পারব না। বিশ্বভারতীর অঙ্গন বা পরিসর কোনও রাজনৈতিক দলকে ব্যহার করতে দেব না। তাতে আমাকে খেসারত দিতে হলেও আমার আপত্তি নেই। অমিত শাহ এখানে এসেছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় এলেও তাঁকে সম্মান দিতে হবে। আমি তো দেখা করতেও চেয়েছিলাম। আমার যুক্তি পরিস্কার।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর চেয়ারে বসা নিয়ে অযথা বিতর্ক। ওটা তো কোনও চেয়ারই নয়। রবীন্দ্রভবনে একটা উইন্ডো এজ। তৎকালীন যুগে চুনসুরকির বাড়ি হত। দেওয়াল চওড়া হত। উইন্ডোর পাশে একটা এজ থাকে। অতিথি এলে ওটাকে চেয়ারের মতো করে তৈরি করা হয়। একটা গদি দিই, দুপাশে দুটো তাকিয়া রাখা হয়। ওটা কিন্তু চেয়ার নয়। সেই গদিতে জহরলাল নেহেরু বসেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধী বসেছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজি বসেছিলেন। একেবারেই ফালতু বিতর্ক।
রাজনীতি হচ্ছে কি না জানি না। ছাত্র-ছাত্রীদের জেনুইন ইস্যু বা অসুবিধা থাকলে নিশ্চয় দেখব। আমার দায়িত্ব রয়েছে। আমারও তো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে সমস্যা হলে সরাসরি ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলি।
প্রথমত আমার নিযুক্তকরণ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। আমার নিয়োগপত্রে সই করেছেন রাষ্ট্রপতি। এই সিলেকশন হয় একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। একটা সার্চ কমিটি করা হয়। ওই সার্চ কমিটিতে সমস্ত বিখ্যাত লোকেরা থাকেন। তাঁরা নাম পাঠান। রাষ্ট্রপতি ও কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নাম সিলেক্ট করেন। কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োগ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার যেহেতু বিজেপি চালাচ্ছে তাই বলছে বিজেপির লোক। আমার প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যাঁদের উপাচার্য নিযুক্ত করেন, তাহলে তাঁরা তৃণমূলের লোক? আমি শুনেছি এখানে তো দৈববানীতে উপাচার্য সিলেকশন করা হয়। সরকার থেকে নাম আসে, সেই নাম সিলেক্ট করতে হয়। রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই তাহলে তৃণমূলের।
বিশ্বভারতীতে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে ৪০০। মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বাংলাদেশ, জাপান, কোরিয়া, চিন, ভুটান, ভিয়েতনামের ছাত্র-ছাত্রীরা আছে। এশিয়ার কথা বেশি ভাবতেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি এশিয়ার দিকে তাকাতে বলতেন। তবে আমেরিকা-ইংল্যান্ডের ছেলেমেয়েরাও আসে। তাঁরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আসে কলাভবন, সঙ্গীতভবন ও ভাষাভবনে। এখন বিশ্বভারতীতে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১৫,০০০।
প্রথমত, আমরা একটা হাসপাতাল করছি। সেটা হবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে। একেবারে অতিপ্রয়োজনীয় ৩০-৩২টা বিভাগ থাকবে। ইউজিসি একটা দোতলা বিল্ডিং করেছিল ১৩ কোটি টাকা দিয়ে। সেটা ২০০৯ তে সম্পূর্ণ হয়েছে। এখনও ওই ভবনটি ব্যবহার হয়নি। ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে আমরা প্রস্তাব দিই। এবছরই চিকিৎসা পরিষেবা চালু হবে। প্রকল্পটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
শিক্ষাভবনে তিন তলা বাড়ি করছি। সেখানে কমন ক্লাস রুম হচ্ছে। নির্দিষ্ট বিভাগ থাকবে না। সায়েন্সের যত বিভাগ আছে। বিদ্যাভবনে সেই ব্যবস্থা আছে। আমরা চালু করতে পারিনি। যেহেতু অন্য জায়গায় নেই। একইসঙ্গে সব জায়গায় করা হবে। এখানে কবজা করার মানসিকতা। রুম কেউ দিতে চায় না। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক থেকে ৬৭ কোটি টাকা পেয়েছি।
৪টে হস্টেল হচ্ছে। ছাত্রদের দু’টি ও ছাত্রীদের দুটি । প্রতি হস্টলে ২৫০ জন করে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং হচ্ছে। সেখানে সমস্ত অফিস নিয়ে আসা হবে। লাইব্রেরি হরাইজেন্টলি বাড়ছে।
বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরি হচ্ছে উত্তরাখণ্ডের রামগড়ে। নৈনিতালের কাছে, সেখান থেকে দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। রামগড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনবার(১৯০৪, ১৯১৩, ১৯৩৭) গিয়েছিলেন। রামগড়ে গীতাঞ্জলির কিছু অংশ লিখেছিলেন{ সেখানে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি(টেগরটপ) আছে। ১০ একর জমি আছে। পাহাড়ের ওপরে বলে কেউ দখল করতে পারেনি। রাস্তাও নেই। হেঁটে যেতে হবে। তবে কেউ দায়িত্বও নেয়নি। বাড়িটা ভেঙে পড়ছে। এখনকার কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পখরিয়াল আগে উত্তরপ্রদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন। সেখানে শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট বানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, প্রয়াণদিবস পালন করা হয়। মন্ত্রী বলেছেন সেখানে সেকেন্ড ক্যাম্পাস হবে। রামগড়ে ৩০০ একর জমি দেবে উত্তরাখণ্ড সরকার। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১ হাজার কোটি টাকা চেয়েছি। কোভিড পরিস্থিতি বলে সমস্যা হচ্ছে।
রাজ্যে শিক্ষার হাল খুব খারাপ। আমরাও সাতের দশকের ছাত্র ছিলাম। এখন সেই লেভেল নেই। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ৪০ বছর কোনও যোগাযোগ নেই। খুব নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। এখানকার যাঁরা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি তাঁদের দেখে মনে হয়েছে এখানে সেই ব্যাপ্তি নেই। তবে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রোটেনশিয়াল আছে। তা ব্যবহার করলে আগের মতো জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লব।
ন্যাক-এ বি প্লাস হয়েছে। আমরা এনআইআরএফ র্যাংকিংয়ে ৫০ নম্বরে এসে গিয়েছি। শিক্ষকরা ক্ষেপে যাবেন, এটা সত্যি এখানে কোনও শৃঙ্খলা ছিল না।
আমি এতে একদিকে খুশি, অন্যদিকে খুব দুঃখিত। রবীন্দ্রনাথকে কোথায় নামাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ একটা পণ্য- যে পণ্যকে ব্যবহার করছি আমাদের সুবিধার জন্য। এজন্য আমার মন খারাপ।
যদি কোনও রাজনৈতিক দল রাবীন্দ্রিক আদর্শে দেশ চালাতে চায় তাহলে সে দেশে সোনার ফসল ফলবে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, স্বদেশের সমাজ যদি দেখা যায় ১৯০৪ সালে সেটা ব্লুপ্রিন্ট করে আমরা যদি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তাহলে দারুণ জিনিস হবে। প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে গ্রাম দত্তক নেওয়ার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ সেটা ১৯২১ সালে বলেছেন। এই ভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। রাবীন্দ্রিক আদর্শে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেলে সেটা খুব আনন্দের কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে পণ্য হিসাবে নিলে, তাহলে সেটা খুব দুঃখের কথা।
আরও পড়ুন- Exclusive: ‘বিশ্বভারতীর প্রতি ক্ষণে ক্ষণে ঘুণ ধরেছে’, বিস্ফোরক উপাচার্য
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন
Get all the Latest Bengali News and West Bengal News at Indian Express Bangla. You can also catch all the West-bengal News in Bangla by following us on Twitter and Facebook
Web Title:
রাগ, অভিমান ভুলে রাজীব-লক্ষ্মীরতন-বৈশালীকে একসঙ্গে লড়াইয়ের বার্তা প্রসূনের
টিকা নিয়েও রাজনীতি! বর্ধমানে ভ্যাকসিন নিলেন তৃণমূল বিধায়করা, তুঙ্গে বিতর্ক
শ্রাবন্তীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ, তার মাঝেই 'মনের বান্ধবী'র সঙ্গে ছবি পোস্ট রোশনের
"স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য ইতিহাস রাহুল গান্ধীকে স্মরণ করবে"
ফাইজারের করোনা টিকা নেওয়ার পর ২৩ জনের মৃত্যু, চাঞ্চল্য নরওয়েতে