Rabindranath Tagore Mahatma & Co: বয়স যে বাড়ছিল তা অনেক আগে থেকেই যেন বুঝতে পারছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ক্রমে ক্রমে বাড়ছিল অসুস্থতার বহর। তবু থামছে না কবির লেখনি। আরও নতুন সৃষ্টির জন্য মেতে উঠেছেন তিনি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গভীর উদ্বেগ। সবার চোখ ছল ছল। অস্ত্রোপাচার সফল হলেও বিছানায় কাতরাচ্ছেন কবি। গায়ে জ্বর। দিনে দিনে অন্যান্য উপসর্গও প্রকট হচ্ছে। সালটা ১৯৪১। নামকরা সব ডাক্তাররা দেখছেন কবিকে। ডাঃ নীলরতন সরকার, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, ললিত মোহন ব্যানার্জী, সত্যসখা মৈত্রের চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসকরা এক পর্যায়ে গিয়ে ঠিক করলেন ওষুধের মিক্সার দেওয়া হবে গুরুদেবকে। তড়িঘড়ি করে সেই ওষুধ আনানো হল জোড়াসাঁকোর খানিক পাশের এক দোকান থেকে। তবুও শেষ রক্ষা হল না। ২২শে শ্রাবণ চিরতরে বিদায় নিলেন কবিগুরু।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের সাক্ষী থেকে গেল এই ওষুধের দোকান। নাম মহাত্মা এন্ড কোং। ২৭৮, রবীন্দ্র সরণী। জোড়াসাঁকোর ট্রাম লাইন ধরে এগোলে সামনেই পড়বে চার রাস্তার মোড়। গণেশ টকিজ। এই গণেশ টকিজ মোড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বোলালেই একবারেই নজর পড়বে বাড়িখানার দিকে। আকাশছোঁয়া প্রাসাদ। এই বিশাল সাতমহলের একতলা জুড়ে রয়েছে ওষুধের দোকান। 'মহাত্মা এন্ড কোং।' গুরুদেবের শেষ কটাদিনের সাক্ষী। ইংরাজি বাংলা আর দেবনাগরী হরফে লাগানো সাইনবোর্ড। কেমিস্টস এন্ড ড্রাগিস্টস। আজও অক্ষত রয়েছে শতবর্ষের কাছাকাছি পুরনো এই দোকান। কবির মৃত্যুর পাঁচদিন আগের প্রেসক্রিপশন আজও সযত্নে গচ্ছিত আছে দোকানটিতে।
দোকানে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়বে ষাটোর্ধ এক ভদ্রলোককে। উনি শম্ভুনাথ রায়। দোকানের বর্তমান কর্ণধার। ওনার বাবা রাধা বিনোদ রায় এই দোকান শুরু করেছিলেন। তখন ওই চত্বরে ওষুধের দোকান বলতে ছিল মাত্র দুটো। তার মধ্যে টিকে রয়েছে মহাত্মা এন্ড কোং দোকানটি। শম্ভুনাথ বাবু দোকানে বসেই বলছিলেন পুরনো দিনের কথা, মাত্র চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে। বাবার পরে দোকানের দায়িত্ব নিয়েছিল বড় দাদা রঞ্জিতকুমার রায়। দাদা এবং অমিতাভ চৌধুরীর লেখা বই 'সূর্যাস্তের আগে রবিন্দ্রনাথের' বই থেকে যতটুকু জানা যায় তা হল, রবীন্দ্রনাথ তখন মৃত্যুশয্যায়। শান্তিকেতন ছেড়ে রয়েছেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। দীর্ঘদেহী সুঠাম দেহ ক্রমশ কঙ্কালসার। যেন মিশে গিয়েছে বিছানায়। স্বনামধন্য ডাক্তাররা কবিকে দেখে যাচ্ছেন একে একে। বিধান রায়, নীলরতন সরকার, ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ভালো হয়ে উঠছেন না তিনি। অনেক জল্পনার পর চিকিৎসকমণ্ডলী ঠিক করলেন, অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এ বিষয়ে আপত্তি ছিল। 'রোগী'র আপত্তি মানতে নারাজ চিকিৎসকেরা। ৩০শে জুলাই অস্ত্রোপচার করা হল।
অপারেশনের চার পাঁচ দিন পরে রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণী সত্যি হয়ে ওঠে। ফেল মেরে যায় ডাক্তারি অনুমান। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন কবি। তাঁর হাতে আর মেরেকেটে ক'দিন। ঢলে পড়বেন মৃত্যুর কোলে। মৃত্যুপথযাত্রীর যন্ত্রণা খানিক লাঘব করতে ডাক্তাররা শেষে বেছে নিলেন মিক্সচার তৈরির পথ। মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে অর্থাৎ ২রা আগস্ট ডাঃ জে পি সরকার লিখলেন প্রেসক্রিপশন, পিল সাইট্রাস, সোডিবাই কার্ব, পট এসিডাস, সিরাপ রোজ কিম্বা হাইড্রাগ, মেনথল, একুল বেলাডোনা ইত্যাদি নানা জটিল রাসায়নিক হিসেব নিকেশের ফসল এইসব মিক্সচার। তখন এখানকার মতন এত ওষুধ ছিল না। বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে তৈরি হত ওষুধ। 'মহাত্মা এন্ড কোং' থেকে নিয়ে আসা হল সেই ওষুধ। তৈরি করে দিলেন স্বয়ং রাধা বিনোদ রায়। প্রেসক্রিপশনের বড় বড় করে লেখা 'আর এন টেগোরে'র নাম। যদিও ওষুধ বেশী দিন খেতে পারলেন না গুরুদেব। ৭ই আগস্ট কবি দিন পাঁচেকের মধ্যেই প্রয়াত হন।
বয়সের ভারে শম্ভুনাথবাবুও এখন অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘আমার বাবা, রাধাবিনোদ রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহাত্মা এন্ড কোং। বাবা ছিলেন গান্ধীভক্ত। শুনেছি গান্ধীজি আমাদের দোকানের নামোল্লেখ করেছিলেন। বাবার সাথে গান্ধীজীর আলাপ ছিল। এছাড়া ডাঃ বিধান রায় তাঁর পেশেন্টদেরকে বলতেন আমাদের কথা। এ তল্লাটে তখন ওষুধের দোকান বলতে দুটো, একটা ছিল আমাদের। আরেকটা খানিকদুরে ওটা বহুদিন হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমরা তখন খুবই ছোটো। ছোটবেলায় জানতাম না, এই দোকান থেকেই কবির ওষুধ গিয়েছিল। পরে জানতে পেরেছি। এখন গর্ব হয় এই দোকান নিয়ে। এই দোকানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। আমার এই দোকান ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চৌরাস্তার মোড়ে। মাঝে মাঝে জোড়াসাঁকোর গেটের দিকে তাকালে গায়ে কাঁটা দেয়। কবিগুরুকে আমরা সেবা করার সুযোগ পেয়েছিল আমাদের এই দোকান।’