Advertisment

Premium: এক যে আছে রাধু বাবুর ছাত্র, সঙ্গী তাঁর যন্ত্রেরা

ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রের বেশিরভাগই রাধিকা মোহন মৈত্র কারো না কারো কাছে উপহার স্বরূপ পেয়েছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাবের দেওয়া ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তৈরি একটি ছোট সেতার এবং আরেকটি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের। এই দুটি সেতারই মূল্যবান।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
Radhika mohan moitra, Radhika mohan moitra artist, Radhika mohan moitra sitar vadak, Kolkata artist news, sashi ghosh, Radhika mohan moitra Rabindranath tagore, Radhika mohan moitra feature

সোমজিৎ দাশগুপ্ত রাধিকা মোহন মৈত্র অর্থাৎ রাধুবাবুর অন্যতম প্রিয় ছাত্র।

কলকাতা ইট কাঠ পাথরের শহর। বড় বড় বাড়িগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। দিনরাত্রি কোলাহল। বাজারে মানুষের হাঁকডাক। এর মাঝেই যদি ভেসে আসে সরোদের কোন রাগ! নিমেষেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শান্ত নদী। পাহাড়ি ঝর্না নেমে আসে সরোদের রাগ হয়ে। এই পৃথিবীর যা কিছু ভালো, যা কিছু খারাপ, সবই সুন্দর। উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ির পাঁচতলা থেকে যতদূর চোখ যায় উঁচু বাড়ি। তার মাঝেই চোখ বুঝে আঙ্গুলের প্রতি স্পর্শে যেন শিহরণ তুলছে, ৬৩ বছরের এক বৃদ্ধ শিল্পী। নাম সোমজিৎ দাসগুপ্ত। ফ্ল্যাটের সামনের বারান্দা দিয়ে মেঘ ভেসে যাচ্ছে। মাথার উপরে রাখা রাধিকা মোহন মৈত্রের ছবি। ঘর ভর্তি বাক্স বন্দী করে রাখা ধ্রুপদী বাদ্যযন্ত্র। 

Advertisment
publive-image
সোমজিৎ দাশগুপ্ত রাধিকা মোহন মৈত্র অর্থাৎ রাধুবাবুর অন্যতম প্রিয় ছাত্র - এক্সপ্রেস ছবি- শশী ঘোষ

সোমজিৎ দাশগুপ্ত রাধিকা মোহন মৈত্র অর্থাৎ রাধুবাবুর অন্যতম প্রিয় ছাত্র। সরোদ, রবাব, সুর-রবাব, মোহন বীণা এবং সুরশ্রৃঙ্গার-এর অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী। এই শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রগুলোর তালিম নিয়েছেন রাধুবাবুর কাছে। প্রথমে আসা যাক কে এই রাধুবাবু? বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো রাধিকা মোহন মৈত্রের নাম শুনে খানিক ভ্রূ কুঁচকবেন! তাদের বলে রাখা ভালো রাধিকা মোহন মৈত্র হলেন ভারতীয় যন্ত্রসঙ্গীতের 'নীরব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।' পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র (১৯১৭-’৮১) সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ভারতের ধ্রুপদী সঙ্গীতকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কেবল বাদন নয়, নানা বাদ্যযন্ত্রের সৃজন ও তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার কারিগর বলা হত পণ্ডিত রাধিকামোহনকে। যার হাতে সুর-তাল-ছন্দ বশ মানত অবলীলায়। সুরবাহার, সুরশৃঙ্গার ও সেতার মিলিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন 'মোহনবীণা'। সেতার, সুরশৃঙ্গার, ভারতীয় ব্যাঞ্জো, সুররবাব এবং সবচেয়ে প্রাচীন ধ্রুপদী রবাবও ছিল তাঁর সংগ্রহে। পণ্ডিত রাধিকামোহন যন্ত্রের সৃজন শুধু নয়, তার সংরক্ষণও করতেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত ঘরানাকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। তাঁরই দেখানো পথেই হাঁটছেন সঙ্গীতশিল্পী ও বাদ্যকার সোমজিৎ দাশগুপ্ত। 

publive-image
রাধুবাবুর ব্যবহৃত মোহন বীণা- এক্সপ্রেস ছবি- শশী ঘোষ

পণ্ডিত রাধিকামোহনের তৈরি মোহনবীণা আজ চতুর্থ প্রজন্ম বাজাচ্ছে। সুপ্রাচীন সুরশৃঙ্গার যন্ত্রও এখনকার শিল্পীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সোমজিৎ বাবু এই যন্ত্রসম্ভার শুধু সংরক্ষণই নয়, তার বাদনও করে চলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁর বছরের অর্ধেক সময় কেটে যায় দেশের বাইরে। একের পর এক অনুষ্ঠানে। মা বাবা গত হয়েছেন বহুকাল আগে। একা ছিমছাম একজন মানুষ। সঙ্গী বলতে এই যন্ত্র। ঘরদোর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। রেওয়াজের মাঝেই তিনি রাধুবাবুর গল্প করছিলেন, "ওনাকে বলা হত, 'অ্যাস্থেটিক লিভিং আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিক'। সেই হিসেবে অগণিত দুষ্প্রাপ্য রাগ লোকে ওনার কাছে শুনতে চাইত। মানে রাধুবাবুরটা শুনে নিতে হবে তাহলে অরিজিন্যালটা পাওয়া যাবে। এই ছিল ভারতবর্ষের সঙ্গীতের চেহারা। মল্লিকার্জুন মনসুর, আল্লাউদ্দিন খাঁ, মোস্তাক হুসেন খাঁ, ঠাকুর জয়দেব সিং এসব মানুষরা নিজে কথায় কথায় বলতেন, 'আরে ও রাগ হ্যা, রাধুবাবুকো সুন লিজিয়ে রেডিও অউর ন্যশানাল প্রোগ্রাম জো হ্যা। তো ইয়ে জাস্টিফাই হো জায়েগা।' এমনটাই ছিল ওনার সঙ্গীতের গুণগ্রাহীরা।"  

publive-image
সোমজিৎ বাবু এই যন্ত্রসম্ভার শুধু সংরক্ষণই নয়, তার বাদনও করে চলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে- এক্সপ্রেস ছবি- শশী ঘোষ

সুর এবং গান হলো রং আর তুলি, ছবি এঁকে যায় নিস্তব্ধতার অনন্ত ক্যানভাসে। এই সুরের মূর্ছনা নিখিল ব্রহ্মাণ্ডে সঞ্চারিত করে আত্মা, মনকে করে সোনালি ডানার দুরন্ত পক্ষিরাজ ঘোড়া, কল্পনাকে নিয়ে যায় দিগন্ত পেরিয়ে অনেক দূরে। আর জীবনকে নিয়ে যায় অমৃতকুম্ভের সন্ধানে। আর রাধিকা মোহন মৈত্রের মতন শিল্পীরা এই কাজটায় করে গিয়েছেন চুপিসারে। সোমজিৎ বাবুর কথায়, নিজের সঙ্গীত গুরুর কাছেই যন্ত্র, সুর, সঙ্গীত সংরক্ষণের পাঠ শিখেছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৫ই অক্টোবর রাধুবাবুর মৃত্যুর পরেই ভারতের সুপ্রাচীন এইসব বাদ্যযন্ত্রের সংরক্ষণের কথা ভাবেন তিনি। শুধু সংরক্ষণই নয়, দুষ্প্রাপ্য সব বাদ্যযন্ত্রে সুরের ঝঙ্কার তুলে তাদের নবজীবনও দিয়েছেন। এই মুহূর্তে চারশোরও বেশী বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহে রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম যে বাদ্যযন্ত্রের কথা না বললেই নয়, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত সেতার। রবীন্দ্রনাথ নিজে তা রাধিকা মোহন মৈত্রকে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে রাধিকা মোহনের ভাই তা দিয়ে গিয়েছেন সোমজিৎ বাবুর কাছে।  

publive-image
রাধিকা মোহন মৈত্রকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের সেতার। এক্সপ্রেস ছবি- শশী ঘোষ

ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রের বেশিরভাগই রাধিকা মোহন মৈত্র কারো না কারো কাছে উপহার স্বরূপ পেয়েছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাবের দেওয়া ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তৈরি একটি ছোট সেতার এবং আরেকটি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের। এই দুটি সেতারই মূল্যবান। সম্ভবত ১৭৭০-এর দশকে সেতারটি শেষবার বাজানো হয়েছিল। যন্ত্রটি খুব ছোট এবং খুব কম পরিচিত কারণ এখনও পর্যন্ত কোনও বইয়ে এর কোনও ছবি নেই, বলছিলেন সোমজিৎবাবু। এই সমস্ত যন্ত্রকে অর্থের জন্যে নয় ভালোবেসে সংরক্ষণ করছেন। ফ্রান্স,আমেরিকার মতন দেশে এই সব যন্ত্রের বেশ কদর রয়েছে। কিছুদিন আগেও ফ্রান্সে এই সব বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী হয়ে গিয়েছে। বাংলায় অনেক দিন সঙ্গীত নিয়ে বড় কিছু করার ভাবনা চিন্তা ছিল। সোমজিৎ বাবুর আক্ষেপ এই দেশের মানুষ এ সব যন্ত্রের কদর বুঝল না। "আমাদের বাংলার সঙ্গীতের মধ্যে কত মধু লুকিয়ে তা যদি এই প্রজন্মকে না জানাতে পারি তবে রাধিকা মোহন মইত্রেরমতন শিল্পীদের কেউ মনে রাখবে না। বাম জামানায় কয়েকবার এই সব যন্ত্রের সংরক্ষণ নিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অন্যে রাজ্যে সম্পূর্ণ সাহায্যের কথা বললেও আমাদের রাজ্যে সরকারের জমিজটের কারণে সমস্ত কিছু আটকে আছে। আমার বিশ্বাস আমার সংগৃহীত যন্ত্রগুলো একদিন সবাইকে দেখাতে পারবো। বলতে পারবো এই যন্ত্রগুলোর গল্প।"

publive-image
ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রের বেশিরভাগই রাধিকা মোহন মৈত্র কারো না কারো কাছে উপহার স্বরূপ পেয়েছিলেন। এক্সপ্রেস ছবি- শশী ঘোষ

রোজ আশায় দিন গোনেন শিল্পী। প্রতিদিনই তাঁর আঙ্গুল ছুঁয়ে যায় রবাবের তার। সুর ওঠে যন্ত্রে। দু চোখ বুঝে আসে। মুছে যায় সমস্ত কষ্ট, চারিদিকে যেন সঙ্গীতের এক জ্যোতির্বলয়, চিত্তশুদ্ধির। অনেক অনেক দু:খ আর যন্ত্রণা ছাপিয়ে এক অদ্ভুত শান্তি। কী প্রবলভাবে এই যন্ত্রকে নিয়ে বেঁচে থাকা যায় তা রাধুবাবুর এই ছাত্রকে না দেখলে বোঝা যেত না!  

West Bengal
Advertisment