খুনিদের নিখুঁত পরিকল্পনার কাছে যেন দিশেহারা পুলিশ! সেই কারণেই সম্ভবত রাজ্যের খনি অঞ্চলের 'বেতাজ বাদশা' রাজু ঝা কে খুনের ১২ দিন পরেও দুষ্কৃতীরা অধরাই রয়ে গিয়েছে। এরাজ্যের বিভিন্ন জেলা ও পড়শি রাজ্য চষে ফেলেছে পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশের বিশেষ দল। খুনিদের গতিবিধির তথ্য মিললেও নাগাল মিলছে না।
ফোন কলের পরিবর্তে খুনিরা 'কলিং অ্যাপ' ব্যবহার করাতেই বিপাকে পুলিশ? প্রাথমিকভাবে এমনই ধারণা ওয়াকিবহাল মহলের। রাজু খুনে যুক্ত দুষ্কৃতীদের ধরতে পুলিশের এখন একমাত্র ভরসা খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ঝালমুড়ি বিক্রেতার দেওয়া বিবরণ। সেই স্কেচ আঁকিয়ে খুনিদের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে পুলিশ। রাজ্যের প্রতিটি থানার পাশাপাশি ও পড়শি রাজ্যের পুলিশের কাছেও রাজু খুনে সম্ভাব্য আততায়ীদের সেই স্কেচ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
কয়লা পাচার মামলায় রাজু ঝার গত ৩ এপ্রিল ইডি-র দফতরে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। তার ঠিক একদিন আগেই খুন রাজু। গত ১ এপ্রিল রাত পৌনে ৮ টা নাগাদ শক্তিগড়ে কলকাতামুখী ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে একটি ল্যাংচার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় সাদা রঙের একটি ফরচুনা গাড়ি। ওই গাড়ির চালকের পাশের সিটেই বসেছিলেন রাজু ঝা। একই গাড়ির পিছনের আসনে বসেছিলেন রাজু ঝার সহযোগী ব্রতীন মুখোপাধ্যায় ও সিবিআইয়ের তদন্তাধীন গরু পাচার মামলায় ফেরার অভিযুক্ত আব্দুল লতিফ। রাজু ঝায়ের গাড়ি শক্তিগড়ে ল্যাংচার দোকানের সামনে দাঁড়ানোর কিছু সময়ের মধ্যেই সেখানে এসে দাঁড়ায় শার্প শুটারদের নীল রঙের একটি চারচাকা গাড়ি।
এরপরেই ওই গাড়ি থেকে নেমে দুই শার্পশুটার পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পর পর গুলি চালিয়ে রাজু ঝার শরীর ঝাঁঝরা করে দিয়ে পালিয়ে যায়। রাজুর পিছনের সিটে বসে থাকা ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ের বাম হাতে গুলি লাগে। জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যান ব্রতীন। শুটাররা এমন হাড়হিম করা হামলা চালানোর সময়েই বেপাত্তা হয়ে যান আব্দুল লতিফ। তবে অক্ষত ছিলেন রাজু ঝার গাড়ির চালক নূর হোসেন।
রোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ড খুব কাছ থেকে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন শক্তিগড়ের ঝালমুড়ি বিক্রেতা আবুজিয়া সেখ। পুলিশ ওই ঝালমুড়ি বিক্রেতার মুখ থেকে গোটা ঘটনা জেনেছে। এমনকী ওই ঝালমুড়ি বিক্রেতার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আততায়ীদের স্কেচও আঁকায় পুলিশ। এছাড়াও রাজু ঝা খুন হওয়ার দিন তাঁর সঙ্গে একই গাড়িতে আব্দুল লতিফের থাকার কথা নূর হোসেন শক্তিগড় থানায় জানান। তাঁর দায়ের করা এফআইআর-এর ভিত্তিতে খুনের ধারায় মামলা রুজু করা হয়। সিট গঠন করে পুলিশ রাজু ঝা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে।
আরও পড়ুন- পাহাড় কোলের এই গ্রাম ঠিক যেন বাঁধানো ছবি! গেলে ফিরতে মনই চাইবে না
পুলিশ তদন্তে নেমেই আততায়ীদের ব্যবহৃত নীল চারচাকা গাড়িটির সন্ধান শুরু করে। ঘটনার দিন গভীর রাতেই শক্তিগড় থানার পুলিশ ঘটনাস্থলের কাছেই নীল গাড়িটির হদিশ পায়। ওই গাড়িটিতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ,কার্তুজ, মদের বোতল ও একাধিক নম্বর প্লেট বাজেয়াপ্ত করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ আরও নিশ্চিত হয় যে ওই নীল গাড়িতে চেপেই আততায়ীরা শক্তিগড়ে এসেছিল। এরপর থেকেই সিটের সদস্যদের তদন্তের যাবতীয় কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নেয় ওই নীল চারচাকা গাড়িটি। শার্প শুটাররা কোথা থেকে ওই নীল গাড়িতে চাপে এবং কোন কোন পথ ধরে এসে তারা শক্তিগড়ে পৌছোঁয়, তার তথ্য অনুসন্ধানে নামে পুলিশ।
সেই তথ্যের ভিত্তিতেই পুলিশ বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার পাশাপাশি বিহার ও ঝাড়খণ্ডও চষে ফেলেছে। ওই সব জায়গার বিভিন্ন পয়েন্ট এবং সড়ক পথের একাধিক টোল প্লাজার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে পুলিশ। আততায়ীদের নীল গাড়িটির যাতায়াতের অকাট্য তথ্য প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ, খবর সূত্রের।
আরও পড়ুন- কাল কেড়েছে সংস্কৃতি, পয়লা বৈশাখে নিম-হলুদ বেটে মাখা আজ শুধুই সোনালী ইতিহাস!
সূত্রের খবর, সিটিভি ফুটেজের সূত্র ধরে তদন্তকারীদের অনুমান এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয় দুষ্কৃতীরা। বিহার, ঝড়খণ্ড, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া হয়ে আততায়ীরা নীল গাড়িটিতে দুর্গাপুরে আসে বলে তদন্তে জানতে পেরেছে পুলিশ। এই দীর্ঘ যাত্রা পথে আততায়ীরা তাদের নীল গাড়ির নম্বরপ্লেট বারবার বদল করেছে বলে দাবি পুলিশের। সূত্রের দাবি, ঝাড়খণ্ডের একটি শো-রুমে আততায়ীরা তাদের নীল চারচাকা গাড়ির টায়ারে নাইট্রোজেন গ্যাস ভরে। তারা মদও কেনে ঝাড়খণ্ডেরই একটি দোকান থেকে। নীল গাড়িটি ৩০ মার্চ দুপুর ২ টোর খানিকটা পর বাঁকুড়ার ’কালাপাথর’ টোল প্লাজায় ১৩০ টাকা টোল মিটিয়ে পার হয়। ওই টোল প্লাজার সিসিটিভি ফুটেজে নীল গাড়িটিতে চারজন সওয়ার থাকার ছবিও ধরা পড়েছে বলে সূত্রের খবর।
এছাড়াও দুর্গাপুরের কাঁকসার বাঁশকোপায় টোল প্লাজার সিসিটিভি ফুটেজেও একই গাড়ির সামনের দিকে চালক সহ দু’জন বসে থাকার ছবি ধরা পড়েছে বলে জানা গিয়েছে। গত ৩১ মার্চ বিকেলে কাঁকসার রাজবাঁধে থাকা রাজু ঝার হোটেলের সামনে নীল গাড়িটির চক্কর কাটার ছবিও সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে। ঘটনার দিন দুপুরে রাজু ঝার হোটেলের সামনে দাঁড়ানো সাদা ফরচুনা গাড়িটিতে একটি ট্রলি ব্যাগ ও অফিস ব্যাগের মতো অন্য একটি ব্যাগ তোলা হচ্ছিল। তখনও হোটেলের সামনে সেই নীল গাড়ির চক্কর মারার ছবি ধরা পড়েছে। এর পর রাজু সহ বাকিরা ওই সাদা ফরচুনা গাড়িতে চেপে রওনা হওয়ার পরেই নীল গাড়িটি রাজুদের গাড়ির পথ অনুসরন করে।
আরও পড়ুন- ‘চাপ’ ছিল তৃণমূল নেতাদেরই, বালুরঘাট-দণ্ডি বিতর্কে স্বীকারোক্তি এক মহিলার স্বামীর
আততায়ীদের ব্যবহার করা গাড়ি সম্পর্কে এত তথ্য মিললেও উদ্ধার করা গেলেও পুলিশকে আততায়ীদের ফোন কলের তথ্য ও টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করতে হিমশিম হচ্ছে। তাই মনে করা হচ্ছে পুলিশকে ঘোল খাইয়ে গোটা শুটআউট প্রক্রিয়া সারতে আগাগোড়া 'কলিং অ্যাপ' ব্যবহার করেছে রাজু ঝার খুনিরা। তাই দুই শার্প শুটারের নাগাল পেতে পুলিশের এখন প্রধান ভরসা প্রত্যক্ষদর্শী ঝাল মুড়ি বিক্রেতার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আঁকা স্কেচ।
এদিকে সূত্রের খবর, রাজু ঝা খুনের ঘটনায় উত্তর প্রদেশের গ্যাংস্টার আমান সিংকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিট। বুধবার হাজারীবাগ কেন্দ্রীয় জেলে গিয়ে তাকে জেরা করা হয়েছে। হাজারীবাগ কেন্দ্রীয় জেলে আলাদা ঘরে আমান সিং কে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা ধরে জেরা করেন তদন্তকারীরা। যদিও রাজু খুন সম্পর্কে কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি আমন সিং। পাশাপাশি আমান সিংয়ের কাছে ধানবাদের কুখ্যাত গ্যাংস্টার প্রিন্সে খানের সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এমনই পুলিশ এবং হাজারীবাগ জেল সূত্রে খবর।
রাজু খুনে যুক্ত আততায়ীদের গাড়ির শেষ লোকেশন পাওয়া গেছে বিহারের ভাগলপুরে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আততায়ীরা রাজুকে এলোপাথাড়ি গুলি করার পর নীল বালানো গাড়িতে চ়ডে শক্তিগড় থানা পর্যন্ত যায়। থানা থেকে কিছুটা দূরে নীল গাড়িটি রেখে তারা সাদা রংয়ের অন্য একটি গাড়িতে চড়ে চম্পট দেয়। পুলিশ বিভিন্ন টোল প্লাজার ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে। ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের টোল প্লাজাগুলির ফুটেজও নেওয়া হয়। তারপরে জানা যায়, ভাগলপুরের কাছে একটি টোল প্লাজায় শেষবারের মতো গাড়িটিকে দেখা গিয়েছিল।