বাঙালীর বরাবরই পায়ের তলায় সর্ষে, কিন্তু রাজ্যে ভ্রমনের নির্দিষ্ট গন্তব্য বাঁধাধরা। দার্জিলিঙ থেকে দীঘা একাধিক বার চষে ফেলা বাঙালি ধর্মীয় পর্যটনের দিকেও ঝুঁকেছেন। তারাপীঠে বারোমাস যে পরিমান পর্যটক আসছেন, তা দেখে রেল দপ্তরও ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু এবার তারাপীঠ থেকে পশ্চিমে যাওয়ার এক নতুন পথ চালু হয়ে গেল রেল দপ্তরের সৌজন্যে। যে পশ্চিমের সঙ্গে বাঙালীর বহু বছরের নাড়ির টান, সেখানে যেতে বাক্স-প্যাটরা বেঁধে রেলের টিকিট পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হতো। সেই গন্তব্য এবার নাগালের মধ্যেই চলে এলো।
প্রায় কুড়ি বছর আগে রামপুরহাট থেকে দুমকা পর্যন্ত রেলপথ চালুর বিষয়ে রেল মন্ত্রকের কাছে প্রথম দাবি পেশ করেন রাজ্যের দুই সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া এবং ডাঃ রামচন্দ্র ডোম। নীতিশ কুমার রেলমন্ত্রী থাকাকালীন প্রস্তাবিত পথের শিলান্যাস করেন। এবার রেল দপ্তর গোটা পথের সমীক্ষা করে রেলপথকে দুমকা থেকে বাড়িয়ে জসিডি পর্যন্ত নিয়ে কয়েকমাস হলো যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করে দিয়েছে। এর ফলে তারাপীঠে থমকে যাওয়া পর্যটকরা নতুন গন্তব্য হিসেবে দুমকা-দেওঘর শুধু নয়, নাগালের মধ্যে পেয়ে গেলেন জসিডি, গিরিডি, মধুপুর, শিমুলতলা সহ অসংখ্য ঐতিহ্যময় পর্যটন ক্ষেত্র।
আপাতত পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি সংস্থার লক্ষ্য, নতুন প্যাকেজ চালু করা। যার প্রদেয় খরচ এবং সময় পুরোটাই নাগালের মধ্যে থাকবে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর। এদিকে তারাপীঠ-দেওঘর-বাসুকীনাথের মতন ধর্মীয় পর্যটন স্থান, ওদিকে পশ্চিমের জলবায়ুতে স্বাস্থ্য উদ্ধার, সব মিলে আকর্ষনীয় হয়ে উঠছে সেই প্যাকেজ। নতুন রেলপথের গোটাটাই নিসর্গশোভায় ভরপুর, কোথাও সাঁওতাল পরগনার ঘন বনাঞ্চল, কোথাও লালমাটির টিলা পাহাড়। কোথাও প্ল্যাটফর্ম গড়া চলছে, নতুন রেলপথ বলে হকার নামমাত্র। পথেই স্টেশন ঘোড়ামারা, সেখানে হকার ওঠেন এলাকার বিখ্যাত প্যাঁড়া নিয়ে। রামপুরহাট থেকে বেলা বারোটায় ছাড়া প্যাসেঞ্জার ট্রেন জসিডি পৌঁছে যাচ্ছে বিকেল চারটের মধ্যে। তবে পর্যটকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ওই পথে চলতি মাসেই চালু হতে চলেছে এক্সপ্রেস ট্রেন। পশ্চিমের নতুন পথে সহজে পর্যটকদের আসা শুরু হয়ে গেছে, শীতে যা বহুগুণ বাড়বে, অনুমান রেল দপ্তরের।
জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, চিত্তরঞ্জন দাস, লীলা মজুমদার, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ থেকে শুরু করে অসংখ্য বাঙালীর মননের ক্ষেত্র ছিল এই এলাকা। এখনও সেই জমানার রায়বাহাদুরদের নামফলক বসানো বাড়ি, বা বহু বাঙ্গালীর পরিত্যক্ত বাংলো, গোটা এলাকা জুড়ে। জলবায়ু এখনও মনোরম। বাংলাভাষীদের ভাবাবেগ-ঐতিহ্য-স্মৃতি সর্বত্র। ইঁদারার জল খেলে এখনও পেটের রোগ সারে, এই যুক্তি মেনে ঘুরপথেও পর্যটকরা এতদিন আসতেন।
ঝাড়খন্ড পর্যটন দপ্তরের এক আধিকারিক জানালেন, বাঙালী পর্যটক সংখ্যায় সবসময় বেশী, এবং রাজ্য সরকার আদিবাসীদের রাজ্যে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরবেন আদিবাসী সংস্কৃতির নানা দিক। আদিবাসীরা বনাঞ্চলের বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে নানারকম নান্দনিক জিনিস তৈরী করেন, সেসব সামগ্রী নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বিপণি করতে চাইছে সরকার, সঙ্গে এলাকার ইতিহাস সম্বলিত স্মারক। অনলাইনে পর্যটনের সমস্ত বিষয়ও সরকার প্রচারে আনতে চাইছে।
স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরা চাইছেন, রেলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পর্যটন প্যাকেজ চালু করতে। তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় গাইড, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, প্রয়োজনে সড়কপথে স্থানীয় ভ্রমন ইত্যাদির দায়িত্ব যেমন নেবেন, তেমন রেলদপ্তর পর্যটকদের যাতায়াতের ক্ষেত্রকে আকর্ষণীয় করে তুলতে এসি ট্রেন চালু করার পাশাপাশি ট্রেনের সংখ্যাও বাড়াক, এমনটাই ইচ্ছে তাঁদের। তাহলে বোতলবন্দী জল খাওয়া বাঙালী এই শীতে আসতেই পারেন তামা-অভ্র-চিনেমাটির স্তরের নীচের স্বাদু জল খেয়ে শরীর চাঙ্গা করতে। একইসঙ্গে মনের খোরাক হিসেবে ধর্মীয় পর্যটনটাও সেরে নিতে পারেন। পাহাড় জঙ্গল কেটে গড়া নতুন রেলপথে ভ্রমণের রোমাঞ্চটাই যে আলাদা।